ইলন মাস্কের মগজ ধোলাই যন্ত্র কত দূর

maxresdefault (20)
জীবনযাপন

ইলন মাস্কের মগজ ধোলাই যন্ত্র কত দূর

বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলোন মাস্কের কম্পানি নিউরালিংক এমন এক প্রযুক্তি আবিষ্কার করছে, যার সাহায্যে মানুষ সুপার হিউম্যান এর ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। নিউরালিংক চিপ মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক সরাসরি কম্পিউটারে ডাউনলোড করা যাবে। এমনকি চাইলে আপনি অন্য কারো ব্রেন আপনার মাথায় আপলোড করতে পারবেন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত এই প্রযুক্তি হয়ত ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ মানব সভ্যতাকেই বদলে দিতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কেয়েকজন মানুষের মস্তিষ্কে নিউরালিংকের চিপ প্রতিস্থাপনও করা হয়েছে।

ইলন মাস্কের মগজ ধোলাই যন্ত্র কত দূর ?

নিউরালিংক মস্তিষ্কে স্থাপন

নিউরালিং এমন একটি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যা মেশিনের সাথে মানুষের যোগাযোগের ধরন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এই কম্পানির প্রথম লক্ষ্য হল, ব্র্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস তৈরী করা। যা মানুষের মস্তিষ্কের একটি কম্পিউটার সংস্করণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই কাজটি করার জন্য নিউরালিংক একটি ডিভাইস তৈরী করেছে, যা সরাসরি মানুষের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করতে হয়। প্রতিস্থাপনের কাজটি যেন সহজ হয়, তার জন্য ব্যাথা মুক্ত সার্জারির ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা হয়েছে।

বর্তমানে নিউরালিংক ডিভাইসটির আকার একটি কয়েনের সমান। এর ভেতর অতি সরু বিদুৎ পরিবাহী ইলেকট্রোড বসানো হয়েছে, যা মানুষের চুলের ২০ ভাগের এক ভাগ। মস্তিকে নিউরালিংক ডিভাইস বসানোর জন্য মাথার খুলির সামান্য একটি অংশ তুলে ফেলতে হয়। এরপর সেই ছিদ্র পথে নিউরালিংক ডিভাইসটি মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি যেহেতু অত্যন্ত নিক্ষুত এবং যথার্থ হতে হবে, তাই কাজটি করার জন্য নিউরালিংক বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ রোবট তৈরী করেছেন। এই রোবটই মানুষের মাথায় অপারেশনের কাজটি করে।

মস্তিকে নিউরালিংক ডিভাইস বসানোর পর থেকেই এই যন্ত্রটি ব্রেন সিগনাল নিয়ে কাজ শুরু করে। একই সাথে ডিভাইসটি সিগনাল সেন্ড এবং রিসিভ করতে পারবে। মস্তিষ্কের সিগনালে নিয়ন্ত্রন নেওয়ার মাধ্যমেই নিউরালিংক বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে যোগাযোগ করতে পারে।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল

নিউরালিংক ডিভাইস এতদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র বানরের ব্রেনে স্থাপন করে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের মস্তিষ্কেও নিউরালিংক ডিভাইস স্থাপন করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। এই স্টাডিতে এখন পর্যন্ত সাত জন অংশগ্রহণকারী আছেন। যাদের মধ্যে কয়েক জনের শারিরীক বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

নিউরালিংক এর অধীনেও একাধিক ধরনের পণ্য থাকবে। গ্রাহকরা যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী ডিভাইস মস্তিষ্কে স্থাপন করতে পারবে। নিউরালিংক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে তাদের ‘টেলিপ্যাথি’ (Telepathy) নামক পণ্যের জন্য। এছাড়াও, তারা কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতেও (UAE) ট্রায়াল শুরু করার অনুমোদন পেয়েছে।

নিউরালিংকের প্রথম পণ্য ‘টেলিপ্যাথি’ ব্যবহারকারীদেরকে শুধুমাত্র চিন্তা ব্যবহার করে ফোন বা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। নিউরালিংকের প্রথম ব্যবহারকারী নোলান তার মস্তিষ্কের ডিভাইস ব্যবহার করে ম্যাকবুক প্রো এর কার্সর নিয়ন্ত্রণ করতে এবং মারিও কার্ট খেলতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি প্রথম দিনেই BCI বা Brain-Computer Interface এর ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। তিনি নিউরালিংকের সাহায্যে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় কাজ করেন, ভাষা ও গণিত শেখেন, লেখালেখি করেন এবং ক্লাস করেন।

নিউরালিংকের অন্য দুজন ব্যবহারকারী এলেক্স এবং আরজে শুধুমাত্র তাদের মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে কল অফ ডিউটির মতো জটিল First Person Shooter গেম খেলতে সক্ষম হয়েছেন। অ্যালেক্স একটি রোবোটিক হাত দিয়ে লিখতে ও ছবি আঁকতে পেরেছেন। নিউরালিংক এবং টেসলার সহযোগিতায় তাকে একটি অপটিমাস (Optimus) হাত দেওয়ার কাজ চলছে, যাতে তিনি বাস্তব জীবনেও এই হাত দিয়ে কাজ করতে পারেন।

ব্র্যাড স্মিথ নােমর আরেক জন নিউরালিংক ব্যবহারকারী মস্তিষ্কের জটিল মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত। তিনি আগে কথা বলতে পারতেন না, এখন তিনি নিউরালিংক ব্যবহার করে যোগাযোগ করতে পারছেন, যা আগে সম্ভবই সম্ভব ছিল না। 

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও সক্ষমতা

নিউরালিংকের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো পুরো মস্তিষ্কের ইন্টারফেস (Whole Brain Interface) তৈরি করা। সেজন্য তারা মস্তিষ্কের জন্য একটি সাধারণ ইনপুট/আউটপুট প্রযুক্তি তৈরি করছে। এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের ক্ষতি না করেই, বিভিন্ন তথ্য মস্তিষ্কে ঢোকানো বা মস্তিষ্ক থেকে বের করা যাবে ।

মস্তিষ্কের ডেটা ব্যান্ডউইথ প্রতি সেকেন্ডে ১ বিট থেকে মেগাবিট এবং তারপর গিগাবিট পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার, এমনকি মিলিয়ন গুণ দ্রুত যোগাযোগ করা সম্ভব হবে, যা বর্তমানে কথার গতি বা টাইপিংয়ের গতির চেয়ে অনেক বেশি।

নিউরালিংক এর পরবর্তী পণ্য হলো ‘ব্লাইন্ড সাইট’ (Blind Sight), যা দৃষ্টিশক্তি হারানো ব্যক্তিদের, এমনকি জন্মগতভাবে অন্ধ বা চোখ বা অপটিক নার্ভ হারানো ব্যক্তিদেরও দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করবে। প্রাথমিকভাবে কম রেজোলিউশনের হলেও, এটি পরবর্তীতে উচ্চ রেজোলিউশন এবং রাডার, ইনফ্রারেড, অতিবেগুনী রশ্মির মত একাধিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যে দেখতে সাহায্য করবে। যা মানুষকে অনেকটা সুপারহিউম্যান ক্ষমতা এনে দেবে। নিউরালিংক আশা করছে ২০২৬ সালে প্রথম ব্লাইন্ড সাইট ডিভাইস অংশগ্রহণকারীর মস্তিষ্কে ইমপ্ল্যান্ট করা হবে।

নিউরালিংক মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের আঘাত এবং স্নায়বিক রোগ বা স্ট্রোকের সমস্যা সমাধানে কাজ করবে। তারা মস্তিষ্কের গভীর অংশে ইলেক্ট্রোড স্থাপন করে, নিউরোলজিক্যাল ডিসরেগুলেশন, সাইকিয়াট্রিক কন্ডিশন এবং নিউরোপ্যাথিক ব্যথাতে ভুগছেন এমন ব্যক্তিদেরও সাহায্য করবে।

ভবিষ্যতে, নিউরালিংক ডিভাইস ব্যবহার করে পুরো অপটিমাস রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। যেন ব্যবহারকারীরা মানসিকভাবেই তাদের রোবটকে দূর থেকে পরিচালিত করতে পারে।

যারা অঙ্গ হারিয়েছেন, তারা অপটিমাস রোবটের হাত বা পা সংযুক্ত করতে পারবেন। ক্ষতিগ্রস্ত নিউরনগুলোর মধ্যকার সিগনাল সংযোগ স্থাপন করার মাধ্যমে শরীরের সম্পূর্ণ কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। এরফলে ঘাড় ভেঙে যাওয়া ব্যক্তিরাও আবার হাঁটতে পারবে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি

নিউরালিংক তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে, চিন্তার মাধ্যমে কম্পিউটার এবং AI এর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে, যা বর্তমানের চেয়ে অনেক দ্রুত এবং স্বজ্ঞাত হবে। নিউরালিংক ব্যবহারকারীরা যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায়, ব্যক্তিগতভাবে এবং নীরবে তাদের চিন্তা সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।

নিউরালিংক বর্তমানে মস্তিষ্কের মোটর কর্টেক্সে ১,০০০ ইলেক্ট্রোড ব্যবহার করছে। পরবর্তী কয়েক মাসে স্পিচ কর্টেক্সে ইমপ্ল্যান্ট করে মস্তিষ্কের সংকেত থেকে শব্দ সরাসরি ডিকোড করা হবে।

নিউরালিংক ২০২৭ সালে প্রথমবারের মতো মস্তিষ্কে মোটর কর্টেক্স, স্পিচ কর্টেক্স এবং ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সের মত একাধিক ইমপ্ল্যান্ট একসঙ্গে ব্যবহার করার প্রযুক্তি উন্মুক্ত করবে। এবং ২০২৮ সালে তারা ব্রেন ইমপ্ল্যান্টের সাথে AI কে একীভূত করার ক্ষমতা যুক্ত করবে। সেজন্য এখন থেকেই নিউরালিংক ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে মাউস কার্সর বা গেম কন্ট্রোলে রূপান্তর করার জন্য উন্নত মেশিন লার্নিং সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে।

মানুষের মস্তিষ্কের কোথায় ইমপ্লান্ট বসাতে হবে তা বোঝার জন্য, সিমেন্সের সাথে কাজ করে নিউরালিংক অত্যাধুনিক স্ক্যানার তৈরী করেছে। ভবিষ্যতে হয়ত এইসব মেশিন দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্জারি করাও সম্ভব হতে পারে।

বর্তমান প্রথম সাতজন অংশগ্রহণকারীর মাথায় ইমপ্ল্যান্ট বসানোর জন্য R1 রোবট ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এই রোবটকেও আরো উন্নত করা হয়েছে, যার ফলে মস্তিষ্কে ইমপ্লান্ট বসাতে আগের চেয়ে প্রায় ১১ গুণ কম সময় লাগবে। সেই সাথে নিউরালিংক তাদের উৎপাদন সক্ষমতাও বৃদ্ধি করছে। যেন তারা প্রথম দিকে প্রতি বছর হাজার হাজার এবং পরবর্তীতে বছরে লক্ষ লক্ষ ইমপ্ল্যান্ট তৈরি করতে পারে।

নিউরালিংক এর এই প্রকল্প প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে হলেও, এটি মানব সমাজে আসলে ইতিবাচক না নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। নিউরালিংকের ডিভাইস জন্মগত ত্রুটি বা জটিল রোগ নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে, তবে সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে এটি নতুন ধরনের সমস্যারও জন্ম দিতে পারে। কারণ অতীতে দেখা গেছে, যুগান্তকারী প্রযুক্তি আবিষ্কারের পর মানুষ প্রায়শই এর যথাযথ ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারই বেশি করেছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।