ইব্রাহিম রাইসি কে পশ্চিমারা ভয় পেতো কেন ?
ইব্রাহিম রাইসি কে পশ্চিমারা ভয় পেতো কেন ?
ভূমিকা
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে, রহস্যজনকভাবে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি মারা গেছেন।
আজারাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করে ফেরার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। সেসময় তার সাথে ছিলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান সহ আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
ইরানের একজন বিচারক থেকে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়েছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। শিয়া ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি, নবীজী (সা) এর বংশধরদের মত কালো পাগড়ি পড়তেন।
রাইসিই প্রথম ইরানি রাষ্ট্রপতি যার আমলে, ইরান শুধু মাত্র ফাঁকা বুলি আওড়ানোর বাদলে সরাসরি ইসরাইলে হামলা পরিচালনা করেছিল। বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী এই ব্যক্তির মৃত্যুতে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই বদলে যেতে পারে।
খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরী
ইরানের রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামো বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অনেকটাই আলাদা। ইরানের নেতৃত্ব মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, অন্যদিকে সরকার। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে নতুন সংবিধান অনুযায়ী দেশটি একজন সুপ্রিম লিডার বা সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার অধীনে পরিচালিত হয়। এখনও পর্যন্ত মাত্র দুইজন ব্যক্তি ইরানের সুপ্রিম লিডার হতে পেরেছেন। ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন ইসলামি বিপ্লবের প্রাণ পুরুষ সৈয়দ রুহুল্লা খোমেনি। যিনি পশ্চিমাদের কাছে আয়াতুল্লা খোমেনি হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লা খোমেনির মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বারের মত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হন সৈয়দ আলী হোসেইনী খামেনি। তিনি আয়াতুল্লা আলী খামেনী হিসেবে অধিক পরিচিত। ১৯৮৯ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ আলী খামেনী ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দ্বায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি নিহত হওয়া রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আলী খোমেনির খুব কাছের লোক। সেই সাথে তিনি দেশটির ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং সরকার, উভয় শাখার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেকারণে অনেকেই ধারণা করছিলেন রাইসিই হয়ত তৃতীয়বারের মত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হবেন।
৮৫ বছর বয়সী খামেনী প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। তাই মনে করা হচিছল রাইসির মত একজন বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হলে, ইরানের অবস্থান বিশ্ব রাজনীতিতে আরো পাকাপোক্ত হবে।
পশ্চিমারা কেন ভয় পায়
ইব্রাহিম রাইসি এমন একটা সময় রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহণ করেন, যখন ইরান তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা, ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনাসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইব্রাহিম রাইসি,ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সাথে ইরানের নিজস্ব উন্নত প্রযুক্তি গড়ে তোলার ব্যাপারে জোড় দেন। ইরানের পরমাণূ কর্মসূচি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন করে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরী করেছিলেন রাইসি।
দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর প্রতিবেশী সৌদি আরবের সাথে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এই ইব্রাহিম রাইসির আমলেই। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ায় ইরানের দূতাবাসে ইসলায়েলী হামলার পর, রাইসির আমলেই ইরান প্রথমবারের মত সরাসরি ইসরায়েলে পাল্টা হামলা চালায়। সবাই মনে করছিল, রাইসি ইরানের সুপ্রিম লিডার হলে, ইসরায়েলকে একদন্ডও শান্তিতে থাকতে দিতেন না। তাই ইসরায়েলের নেতারা খামেনির চেয়ে রাইসিকেই বেশি ভয় পেতো।
ইরানের নেতৃত্বাধীন Axis of Resistance বা প্রতিরোধের অক্ষ সমন্বয়ে ইব্রাহিম রাইসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন। এটি মূলত ইরান ও সিরিয়া সরকার, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি ব্রিদ্রোহী এবং ফিলিস্তিনের হামাসের একটি রাজনৈতিক ও সামকি জোট।
ইব্রাহিম রাইসি রাশিয়া, চীন, তুরষ্ক সহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন; এবং নিজেদেরকে স্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। যার মাধ্যমে তিনি একজন সত্যিকারের বিশ্ব নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমারা তার সম্ভাব্য পরিকল্পনা নিয়ে সবসময় ভীত থাকত।
কর্মজীবন
ইব্রাহিম রাইসি ১৯৬৯ সালে ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশাদে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। রাইসির বেড়ে ওঠার সময়টাতে ইরানে খুবই টালমাটাল পরিস্থিতি চলছিল। রাইসির বাবা ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা। বাবার মত রাইসিও ছেলে বেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এবং শহীদ মোতাহারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্র এবং আইনের মৌলিক বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৮০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে, ইব্রাহিম রাইসি ইরানের বিচার বিভাগে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে বিতর্কিত এক গোপন ট্রাইবুনালের বিচারক প্যানেলে ছিলেন তিনি। যার মাধ্যমে বামপন্থী বিরোধী দলের হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীদের পুর্নবিচার করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। সেকারণে পশ্চিমার রাইসির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে।
১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তেহরানের প্রসিকিউটর জেনারেল হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৪ সাল থেকে দেশটির বিচার বিভাগের উপ-প্রধানের দ্বায়িত্বও পালন করেন।
২০১৪ সালে রাইসি সমগ্র ইরানের প্রসিকিউটর জেনারেলের দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এর দুই বছর পর আলী খামেনী তাকে দেশটির সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আস্তান কুদস রাজাভীর তদারকির দ্বায়িত্ব দেন। এই সংস্থাটি ইরানের কৃষি, বিদ্যুৎ, জ্বালানী, টেলিযোগাযোগ, আর্থিক এবং নির্মাণ কাজ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পরিচালনা করে থাকে।
২০১৭ সালে হঠাৎ করেই তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার ঘোষণা দেন। কিন্তু সেবার ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়ে হাসান রুহানির কাছে হেরে যান রাইসি। তার ক্যারিয়ারের অসাধারণ সাফল্যের ধারায়, ২০১৯ সালে আলী খামেনি ইব্রাহিম রাইসি কে ইরানের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন।
পরবর্তীতে তিনি ইরানের ৮৮ সদস্য বিশিষ্ট “বিশেষজ্ঞ সভা”র উপ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই বিশেষজ্ঞ সভার সদস্যরাই ইরানের সুপ্রিম লিডার বা খামেনির মত নেতা নির্বাচন করেন।
অবশেষে ২০২১ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ইব্রাহিম রাইসি ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।
রাইসির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তার স্ত্রী জামিল তেহরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, এবং তাদের দুটি সন্তান আছে।