আরাকান রাজ্য কি মিয়ানমার থেকে স্বাধীন হবে
আরাকান রাজ্য কি মিয়ানমার থেকে স্বাধীন হবে
ভূমিকা
মিয়ানমার দেশটি বহু নৃতাত্ত্বিক জাতী-গোষ্ঠীর বাসস্থান। এসব গোষ্ঠীর অনেকেই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিয়ানমার থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে। সেকারণে মিয়ানমারের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে বেশ কিছু সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাদো নামে পরিচিত। স্বাধীন হবার পর থেকে প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই তাতমাদো বাহিনীই মিয়ানমার শাসন করে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাতমাদো বাহিনীর ব্যাপক পরাজয়ের কারণে, মিয়ানমারের মাত্র ২১ শতাংশ অঞ্চল দেশটির সেনাসমর্থিত সরকারের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের কর্তৃত্ব হারিয়েছে। রাজ্যটিতে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সিংহভাগ এলাকা দখলে নেওয়ার পর থেকে, ধারণা করা হচ্ছে হয়ত খুব শীঘ্রই রাখাইন রাজ্যটি একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করতে পারে।
আরাকান
অতীতে ১৪৩০ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত আরাকান একটি স্বাধীন দেশ ছিল। ১৭৮৫ সালে তৎকালীন বার্মা সাম্রাজ্য দেশটি দখল করে নেয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের ভিন্ন ভিন্ন শাসকগোষ্ঠী অঞ্চটি শাসন করেছে। সেই ঐতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত স্থানীয় জনগণ বরাবরই তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে গেছে।
যে স্বাধীন আরাকান দেশটির কথা জানা যায়, সেটি ছিল একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত মহাকবি আলাওল এই আরাকান রাজসভার শীর্ষ কবি ছিলেন।
ঐতিহাসিক এবং বিদেশি লেখালেখিতে এই অঞ্চলকে উল্লেখ করতে আরাকান নামটিই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলেও অঞ্চলটিকে আরাকান বলে উল্লেখ করা হতো। আরাকান রাজ্যের পতনের পর মিয়ানমারের আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামোতে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় রাখাইন। তখন থেকে এটি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ হিসেবে পরিচিতি পায়।
রাখাইন রোহিঙ্গা দ্বন্দ
আরাকানের বাসিন্দা বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। ১৪৩০ সালের পর আরাকান রাজ্যের সুলতানদের আমলে এখানে মুসলিমদের বসতি শুরু হয়। ঐ সময় থেকে মুসলিম ব্যবসায়ী ও অভিবাসীরা আরাকানের স্থানীয় সমাজে মিশে যায়। সেসময় পর্যন্ত এখানে বৌদ্ধ-মুসলিম সহাবস্থান বজায় ছিল। কিন্তু ১৭৮৫ সালে বার্মিজ আগ্রাসনের পর থেকে এই অঞ্চলে জাতিগত বিভাজন বাড়তে থাকে।
১৮২৪ সালে ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে নতুন উপনিবেশ স্থাপন করে। বৃটিশরা স্থানীয় প্রশাসনে ভারতীয় মুসলিম অভিবাসীদের প্রাধান্য দেয়, যার ফলে রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের পক্ষে এবং রাখাইনরা জাপানের পক্ষে লড়াই করে। যার ফলে যুদ্ধ শেষে রোহিঙ্গা বনাম রাখাইন দ্বন্দ আরও তিক্ত হয়ে ওঠে এবং পারস্পরিক শত্রুতা বৃদ্ধি পায়।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের “অবৈধ অভিবাসী” হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রবিহীন করে দেয়। এর ফলে রোহিঙ্গারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং কাজের সুযোগের মত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
২০১২ সালে রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে বড় ধরনের সহিংসতা ঘটে। এর পর থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বাড়াতে থাকে। যার পুঞ্জিভূত রূপ হল ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিধন। এই গণহত্যায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয় এবং প্রায় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
রোহিঙ্গারা কয়েক শতাব্দী ধরে প্রাচীন আরাকান অঞ্চলের বাসিন্দা হবার কারণে নাগরিকত্বের অধিকার চায়। কিন্তু রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা শুধুমাত্র তাদের নিজেদেরকে স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। তারা মনে করে রোহিঙ্গারা “বিদেশি” এবং তাদের ভূমি দখল করেছে।
আরাকান আর্মি
আরাকান রাজ্যের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য বর্তমানে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাজ করছে। এদের মধ্যে আরাকান আর্মি সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। ২০০৯ সালে আরাকান আর্মি প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা প্রথমে মিয়ানমারের শান রাজ্যে কার্যক্রম শুরু করলেও, বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইন অঞ্চলে তাতমাদো বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। রাখাইন জনগণের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করাই আরাকান আর্মি মূল লক্ষ্য। তারা মনে করে, মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার রাখাইন জনগোষ্ঠীর প্রতি দীর্ঘদিন ধরে শোষণ ও অবহেলা করে আসছে।
আরাকান আর্মি সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অনেক ঘাঁটি ও অঞ্চল দখল করেছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকা এবং রাখাইনের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের বড় অংশ এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। সেকারণে আরাকান আর্মি বর্তমানে মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি। চীনসহ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সাথে তাদের যোগাযোগ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তারা শুধুমাত্র সামরিকই নয়, বরং প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলারও চেষ্টা করছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আরাকান আর্মির সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে, রাখাইনদের জাত শত্রু রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের বেতন এবং নাগরিকত্ব প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তিন থেকে পাঁচ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
বর্তমান অবস্থা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গা যোদ্ধারা স্থানীয় রাখাইনদের গ্রামে সহিংসতা চালিয়েছিল। এর প্রতিশোধ হিসেবে এপ্রিলের শেষ দিকে আরাকান আর্মিও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় বসতি এলাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আরাকান আর্মি শুধু মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীই নয়, রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন Arakan Rohingya Salvation Army বা ARSA এর বিপক্ষেও যুদ্ধ করছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ অংশে সামরিক জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে আরাকান আর্মি রাজ্যটির দখল নিয়েছে। বিবিসির একটি অনুসন্ধানের দেখা গেছে নভেম্বর মাসে সমগ্র মিয়ানমারে তাতমাদো বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশের মাত্র ২১ শতাংশ এলাকা। এবং মিয়ানমারের প্রায় ৪২ শতাংশ অঞ্চলই বিভিন্ন বিদ্রোহীদের দখলে রয়েছে। এছাড়া দেশের ২১ শতাংশ এখনো তাতমাদো বা বিদ্রোহী কোনো পক্ষেরই নিয়ন্ত্রণে নেই।
মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে, সম্প্রতি থাইল্যান্ডে মিয়ানমারের ৫টি প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। সেখানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না। তাই মিয়ানমারকেই সংকট সমাধানের জন্য বলা হয়েছে। তবে মিয়ানমারের সেই সক্ষমতা আর অবশিষ্ট আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশের ঝুঁকি
রাখাইন রাজ্যে স্বাধীন দেশ গড়ে উঠলে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরী হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিশেষ করে কুকি চীনের মত গোষ্ঠীগুলো আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
নতুন করে উত্তেজনা তৈরী হওয়ার কারণে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন করে প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আরাকান আর্মি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার পর, রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যেতে পারে। তখন হয়ত বাংলাদেশকে আরো বড় রোহিঙ্গা শরনার্থীর ঢল সামলাতে হতে পারে।
আরেকটি বড় ঝুঁকি হল, বাংলাদেশ মিয়ানমান সীমান্তের মাদক চোরাচালানের সম্ভবনা আরো বেড়ে যেতে পারে। সমগ্র মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রধান উৎসই হল মাদক উৎপাদন ও বিক্রি। তাই রাখাইন রাজ্য যার অধীনেই থাকুক না কেন, তারা বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ মাদক সরবরাহ বন্ধ করবে না। কারণ তারা মাদকের উৎপাদক এবং বাংলাদেশ হল তাদের সবচেয়ে বড় বাজার। এমনকি স্থানীয় রাখাইন এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ভেতর দ্বন্দ বা যুদ্ধ চলমান থাকলেও, মাদকের বানিজ্যের ক্ষেত্রে তারা সবসময় আপোস করে চলে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমান্তে নতুন স্বাধীন দেশ তৈরী হলেও, অবৈধ মাদকের চোরাচালান বন্ধ হবে না, উল্টো বেড়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সাথে শত্রুতা চাইবে না। তবে ভৌগলিক ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় স্বাধীন আরাকানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা খুব বেশি স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগও অনেকটাই কম।
অতীতে বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ করেছে বলে খবর পাওয়া যায়। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্র নীতির কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মত বড় বড় উদ্বেগের বিষয়ে দীর্ঘদিনেও কোন সমাধান হয়নি। ভবিষ্যতে আরাকান আর্মি রাখাইনের ক্ষমতায় আসলে, রোহিঙ্গাদের ফেরানো শুধু কঠিনই নয়, বরং অসম্ভব হয়ে পড়বে। তখন প্রত্যাবাসন তো দূরের কথা, নতুন রোহিঙ্গাদের ঢল ঠেকানোই মুশকিল হয়ে যাবে।
অন্যদিেক রাখাইন রাজ্য স্বাধীন হলে, তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।