আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি
ভূমিকা
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হলেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা—অর্থাৎ, তিনি দেশটির সবচেয়ে বড় ও চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। তিনি শুধু একজন ধর্মীয় নেতা নন, বরং ইরানের রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, সেনাবাহিনী এমনকি পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও তাঁর অনুমতি ছাড়া নেওয়া যায় না। বলতে গেলে, তিনিই ইরানের আসল চালক।
১৯৮৯ সালে ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি মারা গেলে, শীর্ষ শিয়া আলেমদের একটি পরিষদ আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে মনোনীত করে। তখন থেকেই তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ইরানের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। তাঁর নেতৃত্বে ইরান অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কখনও পশ্চিমা দেশের সঙ্গে টানাপোড়েন, আবার কখনও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে অনেকেই তাঁকে কঠোর ও রক্ষণশীল একজন নেতা হিসেবে দেখে থাকলেও, ইরানের একটি বড় জনগোষ্ঠী তাঁকে সম্মানের চোখে দেখে এবং মনে করে তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আদর্শ রক্ষা করে চলেছেন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
১৯৩৯ সালে ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর মাশহাদে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি জন্মগ্রহণ করেন। এই শহরটি ইরানের শিয়া মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। আলী খামেনির পরিবার ছিল অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ; তাঁর বাবা ছিলেন একজন সম্মানিত আলেম, যিনি স্থানীয়ভাবে ইসলামি জ্ঞান চর্চা করতেন এবং প্রচার করতেন।
ছোটবেলা থেকেই খামেনির জীবনে ধর্মীয় বোধ গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি প্রথমে মাশহাদের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরে উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষার জন্য চলে যান ক্বোম শহরে। ক্বোম হল শিয়া মুসলিমদের অন্যতম পবিত্র এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। ক্বোমেই তিনি ইসলামি চিন্তাবিদদের সংস্পর্শে আসেন এবং নিজের চিন্তাভাবনার একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেন।
১৯৬২ সাল থেকে তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সে বছর তিনি ইরানের তৎকালীন বাদশাহ শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ইসলামি আন্দোলনে যুক্ত হন। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি, যিনি পরবর্তীতে ইরানী ইসলামী বিপ্লবের জনক হিসেবে পরিচিত হন। আলী খামেনি ধীরে ধীরে রুহুল্লাহ খোমেনির ঘনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে ওঠেন এবং তাঁর আদর্শ ও ভাবধারায় গভীরভাবে প্রভাবিত হন।
শাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আলী খামেনি বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন এবং নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনো পিছু হটেননি। তাঁর মতে, তিনি আজ পর্যন্ত জীবনে যা কিছু করেছেন, তা সবই আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষা নিয়েই করেছেন। রুহুল্লাহ খোমেনির আদর্শই তাঁর রাজনীতি, ধর্মীয় চিন্তা ও নেতৃত্বের মূল ভিত্তি।
বিপ্লবের পর দায়িত্ব পালন
১৯৭৯ সালে ইরানে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনা, যা ইরানী ইসলামী বিপ্লব হিসেবে পরিচিত। এই বিপ্লবের মাধ্যমেই শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর রাজতন্ত্রের পতন ঘটে, আর ইরান রূপ নেয় একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রে। বিপ্লবের পর গঠিত হয় ‘বিপ্লবী পরিষদ’; যা নতুন একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পাশাপাশি দেশের প্রশাসনিক দায়িত্বও গ্রহণ করে। আলী খামেনি ছিলেন সেই বিপ্লবী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য।
পরবর্তী সময়ে তিনি উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং ঠিক এই সময়েই তিনি ইরানের অন্যতম প্রভাবশালী সামরিক সংগঠন ‘Islamic Revolutionary Guard Corps’ বা IRGC গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই বাহিনী পরবর্তীতে শুধু সামরিক শক্তি হিসেবেই নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও ইরানের অন্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
১৯৮১ সালের জুন মাসে তেহরানের একটি মসজিদে আলী খামেনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সেখানে ইরানের এক বামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী বোমা হামলা চালায়। সেই বিস্ফোরণের ফলে আলী খামেনি ডান হাত চিরতরে প্যারালাইজড হয়ে যায়।
সেই বছরই, আগস্ট মাসে, একই গোষ্ঠীর আরেকটি হামলায় নিহত হন ইরানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আলী রাজাই। এরপর সেই শূন্য পদে আলী খামেনিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। তিনি পরবর্তী আট বছর ধরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং এ সময় ইরানের সরকারে স্থিতিশীলতা ও ইসলামি আদর্শ বজায় রাখার কাজ চালিয়ে যান।
১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি মারা গেলে ইরানের রাজনীতিতে এক বড় পরিবর্তন আসে। সংবিধানে সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী পদের বিলুপ্তি ঘটানো হয় এবং রাষ্ট্রপতির হাতে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই সময়েই আলী খামেনিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে মনোনীত করা হয়; যে দ্বায়িত্বে তিনি আজ পর্যন্ত বহাল আছেন।
সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে কর্তৃত্ব
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি শুধু ধর্মীয় বা সাংবিধানিক নেতা নন, তিনি মূলত ইরানি শাসনব্যবস্থার রক্ষাকর্তা। গত কয়েক দশকে যখনই দেশটির শাসন কাঠামোর ওপর কোনো হুমকি এসেছে; তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে তা দমন করেছেন। অনেক সময় এই দমন নীতি হয়েছে কঠোর ও সহিংস। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সক্রিয় করে তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মূল ভিত্তি নড়বড়ে হতে দেওয়া হবে না।
খামেনির অধীনে দায়িত্ব পালন করেছেন চারজন রাষ্ট্রপতি। তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় তাঁর কর্তৃত্বের সীমা চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছেন। কেউ কেউ সংস্কার আনতে চেয়েছেন, কেউ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সহজ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন, আবার কেউ অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা বাড়াতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারোই ক্ষমতা এতটা ছিল না, যাতে সর্বোচ্চ নেতার অবস্থান নড়াতে পারে।
ইরানের ভেতরেও বিভিন্ন সময়ে নানান ইস্যুতে বিক্ষোভ ছড়িয়েছে। কখনও অর্থনৈতিক সংকট, কখনও রাজনৈতিক দুর্নীতি বা সামাজিক স্বাধীনতা; এইসব ইস্যুতে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু খামেনির শাসন কাঠামো এতটাই দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে, কোনো আন্দোলনই তাঁর কর্তৃত্বে চিড় ধরাতে পারেনি। বরং এসব বিক্ষোভকে তিনি রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে দমন করেছেন, অনেক সময় তা রক্তপাতের দিকেও গড়িয়েছে।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও আয়াতুল্লাহ খামেনির অবস্থান বরাবরই ছিল আপোষহীন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলে থাকেন, ইরান কখনও পশ্চিমা শক্তির ছায়াতলে যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরানকে এক অনড় ও কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সব মিলিয়ে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি আজও ইরানের সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবিচলভাবে অবস্থান করছেন। তাঁর কঠোরতা, আদর্শের প্রতি অনমনীয়তা এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাই তাঁকে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ও প্রভাবশালী নেতাদের একজন করে তুলেছে।
উত্তরাধিকার
বর্তমানে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বয়স ৮৬ বছর। বয়সের ভারে তাঁর শরীর ও স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই নানা গুঞ্জন ও জল্পনা চলছে। ইরানের শাসন কাঠামো যেহেতু পুরোপুরি তাঁর নেতৃত্বনির্ভর, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে; খামেনির অন্তর্ধানের পর তাঁর উত্তরসূরি কে হবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশ্লেষকেরা সাধারণত দু’টি নামের দিকে নজর দিয়েছিলেন। একজন হলেন খামেনির পুত্র মোস্তফা খামেনি, যিনি খুব একটা জনসম্মুখে আসেন না, তবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে বেশ প্রভাবশালী। আর অন্যজন ছিলেন ইরানের সাবেক রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি, যিনি খামেনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু ২০২৪ সালের ২০ মে একটি মর্মান্তিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যু শুধু ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নয়, বরং সর্বোচ্চ নেতার সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবেও একটি বড় শূন্যতা তৈরি করে।
এরই মধ্যে ইরান-ইসরাইল সংঘাত যখন চরমে ওঠে, তখন একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিবিএস জানিয়েছে, ইসরাইল ইরানে হামলা চালানোর সময় আয়াতুল্লাহ খামেনিকে টার্গেট করে হত্যার একটি গোপন পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়।
সবমিলিয়ে, খামেনির বয়স ও স্বাস্থ্য, তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন, এবং তাঁকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উত্তেজনা; সবই ইঙ্গিত দেয় যে ইরানের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে এক অস্থির অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।