আমেরিকা কেন ইসরায়েলের কথা মত চলে
আমেরিকা কেন ইসরায়েলের কথা মত চলে
সূচনা
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক শুধু দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বা সামরিক মিত্রতার সীমায় আবদ্ধ নয়, বরং এটি বহুস্তরীয়, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ধর্মীয় অনুভূতির জটিল এক মিশ্রণ। বিশ্বে খুব কম সম্পর্কই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্কের মত এতোটা আলোচিত, সমালোচিত এবং বিতর্কিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় হস্তক্ষেপ করার জন্য, ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ক্রমশই শুধু বেড়েছে। তবে বর্তমান সময়ে এই সম্পর্ক আর শুধু দুই দেশের সরকার বা সামরিক জোটের বিষয় নয়; বরং ইসরায়েলই এখন মার্কিন রাজনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়া গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
কেন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে এত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে?
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে এত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, দুই দেশের মধ্যে “মূল্যবোধের সাদৃশ্য” বা shared values প্রায় একই। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের মতো অস্থিতিশীল অঞ্চলে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক আউটপোস্ট হিসেবে দেখে, যার মাধ্যমে এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব ও গোয়েন্দা তৎপরতা বজায় থাকে।
তৃতীয়ত, ইতিহাসের করুণ অধ্যায় হলোকাস্টের জন্য এক ধরনের “নৈতিক দায়বদ্ধতা” যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে।
এর বাইরেও যে সত্য কেই স্বীকার করতে চায় না তা হল, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল দুটি দেশই গড়ে উঠেছে স্থানীয় আদিবাসীদের জাতিগত নিধনের মধ্যদিয়ে। ইউরোপীয় অভিবাসীরা যেমন, আমেরিকায় থাকা বহু রেড ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের শেয়াল কুকুরের মত হত্যা করে, তাদের উচ্ছেদ করে যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। ঠিক একইভাবে দীর্ঘ ৭৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলীরা ফিলিস্তিনীদের উপর জাতিগত নিধন চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করেছে। কথায় আছে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই, যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের সম্পর্ক যেন সেই প্রবাদের বাস্তব উদাহরণ।
তবে এগুলোর বাইরে প্রকৃত বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল পন্থী বিভিন্ন লবি গ্রুপ, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের ওপর বিভিন্নভােব প্রভাব বিস্তার করে; দুই দেশের সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী হল American Israel Public Affairs Committee; যা সংক্ষেপে AIPAC নামে অধিক পরিচিত। আমেরিকান এই গোষ্ঠীটি ইসরায়েলের স্বার্থে এমনসব কাজ করে, যা খোদ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর।
AIPAC কী?
AIPAC যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ইসরায়েলপন্থী লবি গ্রুপ। আইনি কারণে এরা সরাসরি রাজনৈতিক অনুদান দিতে পারে না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের খুব কম রাজনীতিবিদই আছে যারা AIPAC এর টাকা ছাড়া নির্বাচন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে তারা এমনসব প্রার্থীকে বাছাই করে যারা বিনা শর্তে ইসরায়েলকে সমর্থন করে। এবং সেইসব রাজনীতিবিদদের নির্বাচিত করার জন্য AIPAC সকল ধরনের পদক্ষেপ নেয়। অন্যদিকে যেসকল রাজনীতিবিদ ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদেরকে এমনভাবে দমন করে, যেন তারা আর কোন দিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন নির্বাচনে জিততে না পারে। এই বিষয়টি AIPAC তাদের প্রচারণামূলক ভিডিওতে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছে।
AIPAC যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় রাজনীতিবিদ, কংগ্রেসের সদস্য, প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে, মার্কিন পার্লামেন্টে ইসরায়েলপন্থী নীতি গ্রহণে প্রভাবিত করে। গত অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে AIPAC যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী ব্যবস্থাকেই এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যার মূল উদ্দেশ্যই হল ইসরায়েলকে বিনা শর্তে সমর্থন দেওয়া।
ইসরায়েল গণহত্যা চালাক, মানবতাবিরোধী অপরাধ করুক অথবা জাতিগত নিধন চালাক, কোনটাই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের দেখার বিষয় নয়। তাদের কাজ হল, তারা নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য AIPAC এর টাকা গ্রহণ করবে, এবং বিনিময়ে ইসরায়েলের সকল অন্যায় কার্যক্রমের বৈধতা দিবে।
আমরা সবাই জানি যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চালু রয়েছে। যার একদিকে রয়েছে ডেমোক্রাটিক দল অন্যদিকে রিপাবলিকানরা। কিন্তু AIPAC এর কাছে এমন কোন ভেদাভেদ নেই; AIPAC উভয় দলকেই সমানভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের পকেটে ভরে রেখেছে।
AIPAC এমনই প্রভাবশালী গোষ্ঠী যে, তাদের সম্মেলনে বহু প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যান নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন, কমলা হ্যারিস, হিলারি ক্লিনটন, টেড ক্রুজের মতো রাজনীতিবিদরা যে দলেরই হোক না কেন, তারা সবাই AIPAC এর মঞ্চে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দেয়।
AIPAC কী শুধুই লবিগ্রুপ?
রাজনৈতিক অঙ্গনে AIPAC এর সরাসরি অনুদানের ব্যাপারে বিধিনিষেধ থাকলেও, তারা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী রাজনীতিতে শত কোটি ডলারের বেশি বিনিযোগ করে। তারমানে তারা শুধুই রাজৈনৈতিক লবিগ্রুপ নয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, AIPAC যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নানা স্তরে এমনভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে, তারা সরাসরি নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া বাইপাস করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে সক্ষম।
AIPAC শুধু কংগ্রেস বা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে না, বরং তারা এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে ইসরায়েলকে মার্কিন ঘরোয়া রাজনীতির “ডমেস্টিক ইস্যু” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর ফলে, ইসরায়েল সংক্রান্ত আলোচনা আর শুধু বিদেশনীতি নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই এমন আচরণ করেন, যেন তারা নিজেরাই প্রো-ইসরায়েল লবিস্ট। যেমন, জর্জ বুশ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার দ্বৈত নাগরিকত্ব ছিল, তারা ইসরায়েলি সংস্থা বা কোম্পানির হয়ে কাজ করত; তারা একই সাথে ইসরায়েল সরকারেরও উপদেষ্টা ছিল এবং নেতানিয়াহুর মতো নেতাদের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। অথচ, মার্কিন মিডিয়ার মাধ্যমে তারা “সাধারণ আমেরিকান” হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করত। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, AIPAC শুধু একটি লবি নয়, বরং এটি এমন একটি কাঠামো, যা মার্কিন রাজনীতির অনেক গভীরে প্রোথিত এবং বহু স্তরে প্রভাব বিস্তার করে।
মার্কিন নির্বাচনে AIPAC এর প্রভাব কতটা ব্যাপক?
AIPAC-এর প্রভাব মার্কিন নির্বাচনে অত্যন্ত গভীর এবং জটিল। সরাসরি রাজনৈতিক অনুদান দিতে না পারলেও, AIPAC বিভিন্ন প্রো-ইসরায়েলি প্যাক (Political Action Committees) বা সুপার প্যাকের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই, প্রচারণায় অর্থায়ন, এমনকি ইসরায়েল বিরোধী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় বিপুল অর্থ ব্যয় করে থাকে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনী চক্রে AIPAC এবং তাদের সহযোগী গ্রুপগুলো নির্বাচনী লড়াইয়ে শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান থমাস ম্যাসি, যিনি গাজায় ইসরায়েলের সামরিক হামলার সমালোচনা করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে AIPAC প্রায় ৫ লাখ ডলার ব্যয় করেছে, যার অধিকাংশ টাকাই ব্যয় হয়েছে টিভি ও সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণায়। এমনকি, হোয়াইট হাউসও তাকে “অ্যান্টি-সেমিটিক” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও AIPAC বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। জামাল বোম্যান এবং কোরি বুশের মতো প্রগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটরা, যারা ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় করা হয়েছে।
আর যারা AIPAC এর টাকায় নির্বাচিত হয়, তােদর ইসরায়েলের প্রতি আনুগত্য স্বরূপ নির্বাচনের পর সবাইকে AIPAC এর পক্ষ থেকে ইসরায়েল সফরে নিয়ে যাওয়া হয়। যা মার্কিন সংবিধানের সাথে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা।
জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন জনগণের মধ্যে বিশেষত তরুণ এবং প্রগ্রেসিভ অংশের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কমছে। তাই AIPAC-এর এখনকার চেষ্টার বড় অংশ এই তৃণমূল পরিবর্তন থামানো। মার্কিন রাজনীতিতে এমন শক্তিশালী প্রভাবের কারণে অনেকেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট বা কোনো দলের হাতে নেই, বরং “অন্য কারো” হাতে পরিচালিত হচ্ছে। অার এই অন্য কেউ হচ্ছে AIPAC।
AIPAC এর ক্ষমতার চূড়ান্ত উদাহরণ হল, সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন কংগ্রেসের অনুমতি না নিয়েই ইরানে হামলা চালায়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রেসিডেন্ট কিছুতেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে যুদ্ধ শুরু করতে পারে না। এজন্য তাকে অবশ্যই মার্কিন কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু যুদ্ধটি যেহেতু শুরু করা হয়েছে ইসরায়েলের পক্ষে, সেজন্য ট্রাম্পের বিরোধী দলেরও এ বিষয়ে টু শব্দ করেনি। অথচ এই হামলা যদি ট্রাম্প অন্য কোন পশ্চিমা দেশে বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে করত, তাহলে ট্রাম্প রাতারাতি অভিশংসনের শিকার হত; এবং এই মুহুর্তে প্রেসিডেন্টও থাকতে পারত না।
সহজ করে বলতে গেলে, অামরা সবাই মনে করি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হল মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও আসলে পরোক্ষভাবে AIPAC এর ইশারার পুতুল।