আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক

maxresdefault (8)
জীবনযাপন

আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক

ভূমিকা

আধুনিক বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী, আলবার্ট আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। অনেকের ধারনা, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক হয়ত সাধারণ মানুষের তুলনায় আকারে অনেক বড় ছিল।

আইনস্টাইন নিজে মৃত্যুর আগে চাননি তাঁকে ঘিরে কোনো উপাসনা হোক; তাই তিনি তাঁর শরীর দাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর গোপনে তাঁর মস্তিষ্ক সরিয়ে রেখে গবেষণা চালানো হয়।

আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক কি সত্যিই বড় ছিল ?

আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক বড় না ছোট?

অনেকেই মনে করেন, আইনস্টাইনের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পেছনে নিশ্চয়ই তাঁর বিশাল আকৃতির মস্তিষ্ক ছিল। বাস্তবে এটি মিথ বা কল্প কাহিনী ছাড়া কিছুই নয়।

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের মস্তিষ্কের গড় ওজন ১,৪০০ থেকে ১,৫০০ গ্রাম। কিন্তু ময়নাতদন্তের সময় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ওজন মেপে পাওয়া যায় প্রায় ১,২৩০ গ্রাম। যা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের গড় মস্তিষ্কের ওজনের চেয়ে অনেক কম।

তারমানে মানুষ যে মনে করত আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক অনেক বড় ছিল, তাদের ধারণা শুধু ভুলই না; বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক আসলে গড়পড়তা মানুষের তুলনায় হালকা ছিল, ভারী নয়।

তবে সাধারণভাবে কারো মস্তিষ্ক বড় হওয়ার মানেই তার বুদ্ধিমত্তা বেশি – এই ধারণাটি একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। প্রাণীদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের আকৃতি ও ওজনের সাথে বুদ্ধিমত্তার সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। উদাহরণসরূপ বলা যায়, নীল তিমির মস্তিষ্ক অনেক বড় হলেও তারা কিন্তু মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান প্রানী নয়।

তবে আকারে সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ছোট হলেও, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশের বৈশিষ্ট্য গড় মানুষের তুলনায় একটু ভিন্ন ছিল।

আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের গঠনগত বৈশিষ্ট্য

আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে করা বহু গবেষণায় বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রমী দিক উঠে এসেছে, যা সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কে সচরাচর দেখা যায় না।

সাধারণত মানুষের মস্তিষ্কের ল্যাটেরাল সাল্কাস বা সাইলভিয়ান ফিসারকে পারিয়েটাল অপারকুলাম নামের একটি ভাঁজ ঢেকে রাখে। কিন্তু আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে এই ভাঁজটি অনুপস্থিত ছিল। ফলে তাঁর পারিয়েটাল লোব বিভক্ত না হয়ে আরও বিস্তৃতভাবে যুক্ত ছিল, যা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের যোগাযোগ বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। আইনস্টাইনের পারিয়েটাল লোব প্রায় ১৫% বেশি চওড়া ছিল বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আইনস্টাইন নিজেই বলেছিলেন, তিনি শব্দের বদলে চিত্রকল্পে বেশি চিন্তা করতেন।

১৯৮৪ সালে মারিয়ান ডায়মন্ডের গবেষণায় দেখা যায়, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের বাম পারিয়েটাল অঞ্চলে গ্লিয়াল কোষের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় বেশি। এই কোষ নিউরনকে সহায়তা করে, বর্জ্য অপসারণ করে এবং সিগন্যাল প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। ধারণা করা হয়, ক্রমাগত মানসিক চাপ সামলাতে তাঁর মস্তিষ্কের অতিরিক্ত গ্লিয়া কোষ গড়ে উঠেছিল।

মানব মস্তিস্কের ফ্রন্টাল লোবে সাধারণত তিনটি প্রধান ভাঁজ থাকে, কিন্তু আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে চারটি ভাঁজ দেখা যায়। ২০১২ সালে গবেষক ডিন ফকল দেখান, শুধু   ভিন্ন রকমের ভাঁজ রয়েছে। বিশেষ করে “সাইন অফ ওমেগা” নামে একটি ভাঁজ তাঁর মস্তিষ্কে পাওয়া যায়, যা দক্ষ বেহালা বাদকদের মধ্যেও দেখা যায়। আইনস্টাইন আজীবন বেহালা বাজাতেন, তাই ধারণা করা হয় এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর সংগীতপ্রতিভার সম্পর্ক থাকতে পারে।

২০০১ সালে গবেষক ডালিয়া জায়ডেল আবিষ্কার করেন, আইনস্টাইনের হিপোক্যাম্পাসে অসমতা ছিল। বাম হিপোক্যাম্পাসের নিউরনগুলো ডান দিকের তুলনায় অনেক বড়। যা তাঁর তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে আরও বিশেষ করে তুলেছিল বলে মনে করা হয়।

২০১৩ সালের গবেষণায় দেখা যায়, তাঁর মস্তিষ্কের দুই গোলার্ধকে যুক্তকারী কর্পাস ক্যালোসাম সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি পুরু এবং ঘন ছিল। এতে জটিল সমস্যার সময় মস্তিষ্কের দুই অংশ আরও সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারত।

অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কেই কিছু না কিছু ভিন্ন থাকে। তাই এসব বৈশিষ্ট্রের কারণেই আইনস্টাইন জিনিয়াস হয়ে উঠেছিলেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের রহস্যময় সংরক্ষণ

আইনস্টাইন ১৯৫৫ সালে মৃত্যুবরণ করার পর তাঁর মস্তিষ্ক নিয়ে তৈরি হয় দীর্ঘ এক রহস্য। ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকা প্রিন্সটন হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট থমাস হার্ভে, কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক খুলে লুকিয়ে রাখেন। পরবর্তীতে মস্তিষ্কটিকে টুকরো করে প্রায় ২৪০টি নমুনা তৈরি করা হয়। হার্ভে নিজে কিছু অংশ রেখে বাকিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন স্নায়ুবিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার জন্য পাঠিয়ে দেয়।

আইনস্টাইন চেয়েছিলেন তার দেহ যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। তাই তাকে দাহ করার পর তাঁর ছাই নদীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু মস্তিষ্ক ও চোখ সেই প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যায়। মস্তিষ্ক সংরক্ষণের অনুমতি যদিও তখনও দেওয়া হয় নি, পরবর্তীতে আইনস্টাইনের ছেলে হ্যান্স আলবার্ট শর্তসাপেক্ষে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।

প্যাথলজিস্ট থমাস হার্ভে মস্তিষ্ক নিয়ে প্রথমদিকে কোনো ফলাফল প্রকাশ করেননি। দীর্ঘ ২৩ বছর পর, ১৯৭৮ সালে তাঁর কাছে মস্তিষ্ক থাকার খবর প্রকাশ্যে আসে। এতদিন তিনি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক বাসার কুলারের নিচে ফেলে রেখেছিল। ১৯৮৫ সালে মারিয়ান ডায়মন্ড গ্লিয়া কোষ নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, এরপর ধীরে ধীরে আরও বহু গবেষণা হয়।

২০১০ সালে আইনস্টাইনের মস্তিস্কের কিছু অংশ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ হেলথ অ্যান্ড মেডিসিনে জমা রাখা হয়। আর ২০১১ সালে ফিলাডেলফিয়ার মটার জাদুঘর মস্তিস্কের কিছু স্লাইড সংগ্রহ করে এবং ২০১৩ সাল থেকে তা জনসাধারণের জন্য প্রদর্শন শুরু করে।

আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে সমালোচনা

আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে করা গবেষণা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয় এবং কৌতূহল উদ্রেককারী। বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীরা এতে ভিন্ন ধরনের ভাঁজ, অতিরিক্ত গ্লিয়াল কোষ কিংবা দুই গোলার্ধের অস্বাভাবিক সংযোগের মতো বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। তবে এ থেকেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে এসবের কারণেই তাঁর অসাধারণ প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল।

সবচেয়ে বড় সমালোচনার জায়গা হলো একটি মাত্র মস্তিষ্ক, তাও মৃত অবস্থায়, পরীক্ষা করে কোনো সাধারণ বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত টানা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কই কিছু না কিছু দিক থেকে আলাদা, তাই আইনস্টাইনের ক্ষেত্রেও আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বৈশিষ্ট্য তাঁর জিনিয়াস হওয়ার কারণ কি না, তা জানার জন্য বহু মানুষের মস্তিষ্কের তুলনামূলক গবেষণা প্রয়োজন।

আরেকটি সমালোচনা হলো, যেসব গবেষণায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে ব্যতিক্রমী দিক পাওয়া গেছে, সেগুলোই বেশি আলোচিত হয়েছে। অথচ ব্রিট অ্যান্ডারসনের গবেষণায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের বহু স্বাভাবিকতা দেখা গিয়েছিল; কিন্তু সেই গবেষণা তেমন প্রচার পায়নি। কারণ তা জনপ্রিয় ধারণার বিপরীত।

একইভাবে মারিয়ান ডায়মন্ডের গ্লিয়াল কোষ নিয়ে কাজও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, কারণ তিনি তুলনার জন্য মাত্র ১১ জন মানুষের মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছিলেন, যাদের বয়স ও বুদ্ধিমত্তা ছিল ভিন্ন।

এছাড়া পারিয়েটাল লোব বা কর্পাস ক্যালোসামের ব্যতিক্রমী গঠন নিয়ে করা অনুমানগুলোও এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত নয়। সমালোচকরা বলেন, মৃত মস্তিষ্কে কেবল গঠন দেখা যায়, কিন্তু সৃষ্টিশীল চিন্তার জটিলতা বোঝা যায় না।

সব মিলিয়ে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা যেমন আমাদের কৌতূহল মেটায়, তেমনি শিক্ষাও দেয়। তাঁর প্রতিভা সম্ভবত শুধুই মস্তিষ্কের ভিন্ন গঠন থেকে নয়, বরং জিনগত বৈশিষ্ট্য, জীবনভর অধ্যবসায়, পরিবেশ ও নিরন্তর সাধনার সম্মিলিত ফল। তাই আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক বিজ্ঞানীদের কাছে শুধু গোলক ধাঁধাঁই নয় নয়, বরং সৃষ্টিকর্তার অপার রহস্যও বটে।

আইনস্টাইনের মতই মানব ইতিহাসের এক অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তি ইবনে সিনা। চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হলেও, ইবনে সিনার জ্ঞান শুধুমাত্র চিকিৎসা শাস্ত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন বহু শাস্ত্র বিশারদ। ইবনে সিনা ছিলেন মূলত প্রাক-আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক। সেই সাথে তিনি একাধারে জ্যোতির্বিজ্ঞান, আলকেমি, ভূগোল এবং ভূতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, ইসলামি ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, এমনকি সাহিত্যেও অসামান্য অবদান রেখেছেন।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।