অনলাইন জুয়ার বাজার

maxresdefault (9)
জীবনযাপন

অনলাইন জুয়ার বাজার

অনলাইন জুয়ার বাজার

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে অনলাইন জুয়ার বাজার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য প্রায় ১১৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৯ সালের মধ্যে জুয়ার ব্যবসা ১৮৬.৫৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস করা হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে প্রায় প্রতি পাঁচজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অন্তত একবার অনলাইনে জুয়া খেলেছেন। স্মার্টফোনের ব্যাপক ব্যবহার অনলাইন জুয়ার এই বৈশ্বিক বিস্তারে বিরাট ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে অনলাইনে জুয়া খেলায় মোট ৮০ শতাংশ স্মার্টফোনের মাধ্যমে হচ্ছে। ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বৈশ্বিক অনলাইন জুয়ার প্রায় ৪৯% আয় ইউরোপ থেকে আসে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অনলাইন জুয়ার বাজার দ্রুত বড় হচ্ছে। দেশে শতাধিক অনলাইন জুয়া সাইট ও অ্যাপের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ নিয়মিত জুয়া খেলেন। ধারণা করা হয় ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৬ সালে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বাজার প্রায় ৪.৭% বৃদ্ধি পেতে পারে।

ইতিমধ্যেই দেশের অনলাইন জুয়ার লেনদেনের পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই বিপুল অর্থ অবৈধ পথে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতি থেকেও মূলধন বের করে নিয়ে যাচ্ছে।

অনলাইন জুয়ার আসক্তি কতটা ভয়াবহ ?

অনলাইন জুয়া কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে?

অনলাইন জুয়ার জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এর সহজলভ্যতা ও সুবিধা। ঘরে বসে শুধুমাত্র ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের মাধ্যমে ক্যাসিনো গেম বা খেলাধুলার উপর বাজি ধরা যায়। এ জন্য সময় ব্যয় কলে অথবা স্থান পরিবর্তন করে অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার পরে না। ফলে ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝেও মানুষ কয়েক ক্লিকেই জুয়ায় অংশ নিতে পারছে, যা অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ক্যাসিনোপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছে।

এছাড়া প্রচলিত ক্যাসিনোর তুলনায় অনলাইনে বিভিন্ন ধরণের গেম ও বাজির বিপুল ভাণ্ডার রয়েছে। এর ফলে অনলাইন জুয়ারিরা কখনই বিরক্ত হয় না, বরং তাদের একঘেয়েমি দূর করার জন্য নানা ধরনের আকর্ষণীয় বিষয় একের পর জুয়ার অ্যাপ গুলোতে আসতে থাকে।

অনলাইন ক্যাসিনোগুলো বড় অঙ্কের মুনাফা করার ফলে তারা আগ্রাসী বিজ্ঞাপন ও বোনাসের প্রস্তাব দেয়। তারা স্বাগত বোনাস, ফ্রি স্পিন ও লয়্যালটি প্রোগ্রামের মত নতুন ও পুরনো উভয় ধরনের খেলোয়াড়কে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।

শতাধিক বিদেশি বেটিং সাইট ও অ্যাপ বাংলাদেশের তরুণদের আকৃষ্ট করছে এবং টেলিভিশন থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত এসবের বিজ্ঞাপন চলছে। সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা বিপুল অর্থের লোভে এসব স্পন্সরশিপ গ্রহণ করছে।

খ্যাতনামা ক্রিকেটার ও অভিনেতাদের দিয়ে এসব প্ল্যাটফর্মের এমনসব বিজ্ঞাপন করানো হচ্ছে, যা দেখে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ যুবসমাজ জুয়ার প্রতি বিশেষভাবে আকর্ষিত হচ্ছে।

সঙ্গত কারণেই আমরা এখানে কোন জুয়ার কম্পানির নাম উচ্চারণ করবো না। কারণ অনেক দর্শক আবার সেসব জুয়ার অ্যাপের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন। এসব জুয়ার কম্পানিগুলোর প্রচার-প্রচরণার জন্য একাধিক দেশী বিদেশী এজেন্ট বা দালাল থাকে। এরা অত্যন্ত আগ্রাসী মার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালায়।

এমন একটি জুয়ার কম্পানি কিকেনকিভাবে প্লাটফর্মে তাদের জুয়ার অ্যাপ প্রচারের জন্য বহুবার অনুরোধ করেছে। আমরা তাদের অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়ার পর, কমপক্ষে ১৫ টি এজেন্ট একের পর এক ওই একই জুয়ার অ্যাপ প্রচারের অনুরোধ নিয়ে এসেছে। একটি ইউটিউব চ্যানেলের পেছনে যদি ওরা এতটা সময় দেয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে ওদের মিডিয় বায়িং এ ওরা কত টাকা আর সময় ব্যয় করে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

নৈতিকতা বিবর্জিত গমাধ্যম থেকে শুরু করে বড় বড় তারকারা অবলীলায় এইসব জুয়ার অ্যাপ প্রচার করে যাচ্ছে। যার ফলে, বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের যেভাবে বিস্তার ঘটেছে, একইভাবে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়ার আসক্তি।

পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজে লেনদেনের সুবিধা এবং অনলাইনে গোপনীয়ভাবে খেলার সুযোগ থাকায় অনেকেই নির্দ্বিধায় এই জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে অনলাইন জুয়া খেলার সহজলভ্যতা এবং ব্যাপক সুবিধার কারণেই ৪৮ শতাংশ লোক এই  নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে।

মানুষ কেন জুয়ার ফাঁদে পা দেয়?

মানুষ বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও আর্থিক কারণে জুয়ার ফাঁদে পা দেয়। প্রধান কয়েকটি কারণ হলো: ১. উত্তেজনা ও রোমাঞ্চের আকর্ষণ ২. দ্রুত অর্থের লোভ ৩. সামাজিক প্রভাব ও চাপ ৩. মানসিক চাপ থেকে পালানো এবং ৪. সহজলভ্যতা ও গোপনীয়তা।

জুয়া খেলার সময় জেতার সম্ভাবনা থেকে যে অ্যাড্রেনালিন-জনিত উত্তেজনা ও আনন্দ অনুভূত হয়, তা অনেকের কাছে বড় প্রলোভন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই আবার সহজে বড় অঙ্কের টাকা জয়ের আশায় জুয়া শুরু করেন। হঠাৎ বড় পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা তাদের কাছে আর্থিক সমস্যার দ্রুত সমাধান কিংবা রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে মনে হয়।

কিন্তু একটি বিষয় জেনে রাখা ভালো, জুয়ার অ্যাপ গুলো তৈরীই করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে সাধারণ জুয়ারীরা এখানে দীর্ঘমেয়াদে কখনও জিততে না পারে। তারা নতুন জুয়ারীদের প্রথম দিকে সামান্য কিছু টাকা জেতার সুযোগ দেয়। যাতে তারা মনে করে, ভবিষ্যতে আরো বেশি টাকা জেতার সম্ভাবনা আছে।

অনেকেই আবার বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণ করে। পাশাপাশি জনপ্রিয় খেলোয়াড় বা সেলিব্রেটিদের বিজ্ঞাপন-প্রচার তরুণদের মাঝে জুয়া সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ায়।
এছাড়া ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা বা মানসিক চাপ থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে কিছু মানুষ জুয়াকে আশ্রয় হিসেবে বেছে নেন। জুয়ার রোমাঞ্চ তাদের দৈনন্দিন হতাশা বা উদ্বেগ থেকে কিছুক্ষণের জন্য মনোযোগ সরিয়ে রাখে।

স্মার্টফোনের মাধ্যমে ঘরে বসেই নিভৃতে জুয়া খেলার সুযোগ পাওয়া যায় বলে, সামাজিক বাধা বা লজ্জার ভয় ছাড়াই অনলাইনে পরিচয় গোপন রেখে খেলা যায়। আর সেকারণেই মানুষ বারবার আর্থিক লোকসানের পরও জুয়ার অ্যাপগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ে।

অনলাইন জুয়ায় আসক্তি

অনলাইন জুয়া ধীরে ধীরে ব্যবহারকারীর মধ্যে নেশা তৈরি করতে পারে। জুয়া খেলার সময়ে মস্তিষ্কের পুরস্কার-মূলক স্নায়ুব্যবস্থা সক্রিয় হয় এবং ড্রাগ বা অ্যালকোহল ব্যবহারের মতো ডোপামিন হরমোন নিঃসৃত হয়ে তীব্র আনন্দ ও উত্তেজনা তৈরী করে।

ফলে প্রথমদিকে জুয়া খেলে অত্যন্ত উত্তেজনা ও তীব্য সুখ অনুভব হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই স্বাদ পানশে লাগতে শুরু করে। তখন আগের সেই তীব্র আনন্দ পেতে মানুষ বারবার জুয়ার আশ্রয় নিতে শুরু করে। একসময় পরিস্থিতি এমন হয় যে জুয়া ছাড়া আর কোনো কিছুতেই আগের মতো ভালো লাগে না। তখন পূর্বের মতো উত্তেজনা অনুভবের জন্য জুয়ারিরা বাজির পরিমাণ ক্রমশ বাড়াতে থাকে।

জুয়ায় ধারাবাহিকভাবে হারতে থাকলে অনেকে হারানো টাকা পুনরুদ্ধারে আরও বড় অঙ্কের বাজি ধরতে শুরু করে, যা এক ধ্বংসাত্মক চক্রের জন্ম দেয়। আসক্ত ব্যক্তি নিজের জুয়ার অভ্যাস পরিবার থেকে গোপন রাখতে শুরু করে এবং এই জুয়ার নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য চুরি বা জালিয়াতির মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে।

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিদের কয়েকটি লক্ষণ ও আচরণ হলঃ সবসময় জুয়ার কথা চিন্তা করা এবং পরবর্তী বাজির পরিকল্পনায় মগ্ন থাকা। আগের মতো উত্তেজনা পেতে ক্রমেই বেশি টাকা বাজি ধরতে চাওয়া। জুয়া কমানোর বা থামানোর চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হওয়া। জুয়া কমানোর চেষ্টা করলে তীব্র অস্বস্তি বা মেজাজ অত্যন্ত খিটখিটে হয়ে যাওয়া। ব্যক্তিগত সমস্যার কথা ভুলে থাকতে বা মনখারাপ দূর করতে জুয়ার আশ্রয় নেওয়া। পূর্বে হারানো টাকা ফিরে পাওয়ার আশায় আরও বেশি বাজি ধরা অর্থাৎ লসের পেছনে ছোটা। জুয়ার কারণে পরিবার, সম্পর্ক, চাকরি বা পড়াশোনার দায়িত্বে অবহেলা করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। সবশেষে জুয়ার কারণে গুরুতর আর্থিক সংকটে পড়া এবং নিঃস্ব হয়ে গিয়ে মারাত্নক ঋণগ্রস্ত হওয়া।

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার প্রভাব

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের উপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে অনলাইন জুয়া ইতিমধ্যে দেশে একটি সামাজিক ব্যাধির রূপ নিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম জুয়ার নেশায় পড়ে অনেকেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, সমাজে সহিংসতা ও অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। জুয়া সংক্রান্ত বিরোধের জেরে মারামারি খুনের মতো ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত। সামগ্রিকভাবে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

জুয়ার আসক্তি অনেক পরিবারকে অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের কোনো সদস্য জুয়াড়ি হলে সংসারের সঞ্চয় উড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ জুয়ার পেছনে সম্পত্তি জমিজমা বিক্রি করে নিঃস্ব হচ্ছেন। জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তির কারণে পরিবারে কলহ ও অশান্তি বেড়েছে, বহু ক্ষেত্রে দাম্পত্য বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটছে। এমনকি নিঃস্ব হয়ে পড়ার হতাশা থেকে আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটছে।

অনলাইন জুয়ার কারণে দেশীয় অর্থনীতিতেও কুপ্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ায় লগ্নিকৃত বিপুল অর্থের বড় অংশই অবৈধ পথে দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০২৫ সালের সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনলাইন জুয়া খেলা বা জুয়ার অ্যাপ-সাইট চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে – এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা দেশজুড়ে অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ইতিমধ্যে জুয়ার সাথে জড়িত ১ হাজারেরও বেশি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ও অ্যাকাউন্ট শনাক্ত ও বন্ধ করেছে। এসব সামান্য পদক্ষেপ নিয়ে জুয়ার মত মরারত্ন মহামারি দমন করা সম্ভব নয়।

সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, দেশের গণমাধ্যম সহ সকল ধরনের প্রচার মাধ্যমে এখনও দেদারসে জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে অনলাইন জুয়ার অবাধ প্রসর ঘটছে। এখনই এই সামাজিক মাহামরি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে, ভবিষ্যতে এই ব্যাধি সমাজকে ঘুঁনে খাওয়ার মত ভেতর থেকে অসার করে দিবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।