মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। উদ্বাস্তু, রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের নির্যাতিত ও শোষিত হবার মধ্য দিয়ে যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা আজ মায়ানমারের গন্ডি পেরিয়ে পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
জাতিগত নিধনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জানব কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।
রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ মানুষ রোহিঙ্গা। তাদের সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ। রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব সহ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা রিলিফওয়েব এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২৯ লক্ষ। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের “বিশ্বের সবচেয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ধারণা করা হয়, রোহিঙ্গা নামটি আরাকানের রাজধানী ম্রোহং থেকে এসেছে। ম্রোহং শব্দটি ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে (ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা) রোহিঙ্গা শব্দটি এসেছে। ৭ম ও ৮ম শতাব্দীর দিকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীতে ১৩ থেকে ১৪ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে, রাখাইন, চাটগাঁইয়া, বার্মিজ, বাঙ্গালি, ভারতীয়, মধ্য এশীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিশ্রণে এই জনগোষ্ঠী পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
অষ্টম শতাব্দীর দিকে আরাকান অঞ্চলের রামব্রী দ্বীপের কাছে আরব বণিকদের একটি জাহাজ বিধ্বস্ত হয়। সেসময় রাজা মহত ইং চন্দ্রের সহায়তায় কিছু আরব বণিক এই অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে তাদের অনেকেই রাজার অনুমতিক্রমে আরাকানে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। ১৪ শতকের দিকে বৌদ্ধ রাজা নারামেখলার (ঘধৎধসবরশযষধ) দরবারে, আরাকানী মুসলমানদের অবস্থান বেশ উঁচুতে ছিল। সম্রাট নারামেখলার উত্তরসূরীরা ১৪৩৭ সালে রামু ও ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। এসময় বৌদ্ধ রাজার শাসন থাকলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেয়া হত। এরপর ১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে নেয়। এসময় বার্মিজ শাসকদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব ও নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা আরাকান থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসে। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশদের সাথে বার্মিজদের যুদ্ধ শুরু হয়। যা প্রথম এ্যংলো-বার্মা যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ বাহিনী আরাকান দখলের পর, বিট্রিশ-ভারত থেকে অনেকেই আরাকানে পাড়ি জমাতে শুরু করে। এর ফলে স্থানীয় রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সেই থেকে রাখাইনে শুরু হওয়া জাতিগত উত্তেজনা আজ পর্যন্ত চলমান রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে জাপান বার্মা আক্রমণ করে, ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তাদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখে। এরপর ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা পুনরায় বার্মা দখল করতে সক্ষম হয়। বিশ্বযুদ্ধকালীন পুরোটা সময় রোহিঙ্গারা বৃটিশদের পক্ষে ছিল। কারণ, ব্রিটিশরা রোহিঙ্গাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা হবে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্রিটিশরা মূলত রোহিঙ্গাদের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি ব্রিটিশরা। ১৯৪৬ সালের মে মাসে রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করেন। রোহিঙ্গারা এসময় রাখাইন প্রদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। তার দুই মাস পর রোহিঙ্গারা “নর্থ আরাকান মুসলিম লীগ” গঠন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরাকানকে মায়ানমারের সাথেই রাখা হয়। ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পাকিস্তানের একটি আলাদা প্রদেশ হিসেবে যুক্ত হবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গাদের চূড়ান্ত দুঃখের যাত্রা।
১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করার পর রোহিঙ্গাদেরকে বিদেশি জনগোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আরাকানে একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জানাচ্ছিল। ১৯৬২ সালে নে উইন (ঘব ডরহ) সামরিক জান্তা বার্মার ক্ষমতা দখল করে নেয়। তখন থেকে সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের দাবি প্রত্যাখান করে তাদেরকে কঠোর ভাবে দমন করতে শুরু করে। দমন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা এসময় বার্মা থেকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়। ১৯৮২ সালে মায়ানমারে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট চরম আকার ধারণ করে। এই নাগরিকত্ব আইনে ১৩৫ টি নৃগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হলেও, বার্মার নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করা হয়। মায়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ জনগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেয়। ১৯৮২ সালের সেই মায়ানমার নাগরিকত্ব আইনের মধ্য দিয়েই মূলত, রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত হয়।
মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। রোহিঙ্গাদের সরকারি চাকরী করা কিংবা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। জমির মালিকানাসহ ভূসম্পত্তির উপর কোন প্রকার অধিকার নেই রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য গেটো বা বিশেষ ধরনের বস্তি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে বার্মা সরকার। মায়ানমারের এসব গেটোর ভেতরে আবদ্ধ অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করে তারা। এই গেটো থেকে বের হতে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। এমনকি বিয়ে বা সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গাদেরকে মায়ানমার সরকারের অনুমতি নিতে হয়। রোহিঙ্গাদের জন্য দুটির বেশী সন্তান জন্মদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব বিধিনিষেধের কারণে রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য এক বিশাল কারাগারে পরিণত হয়।
মায়ানমার সরকারের দমন নিপীড়নের শিকার হয়ে ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। ৮০র দশকের পর কয়েক দফায়, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের ভয়ে প্রায় ২ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর ১৯৯১-৯২ সালে ঞযব ঝঃধঃব খধি ধহফ ঙৎফবৎ জবংঃড়ৎধঃরড়হ ঈড়ঁহপরষ এর মাধ্যমে মায়ানমার সরকার, উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দমনের নামে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নির্যাতন শুরু করে। এসময় মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইনদের অত্যাচারের মুখে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আবারো বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট কথিত সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে, মায়ানমার সেনাবাহিনী উত্তর রাখাইনে বড়সড় অভিযান চালায়। এই অভিযানের সময় রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মংডু, বুথিডং ও রাথেদং অঞ্চলের ৪৭১টি গ্রামের মধ্যে ২১৪টি গ্রাম সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। এসময় সেনাবাহিনী ও মগদের হাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, বার্মিজ বাহিনী রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। সেসময় প্রাণে বাঁচতে প্রায় ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকে রোহিঙ্গা সংকটের কারনে সবচেয়ে বেশী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রাতিষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৩ লক্ষ। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা তার চেয়েও অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এমনকি বাংলাদেশের টেকনাফ- উখিয়া অঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা স্থানীয় বাংলাদেশী জনগনের চেয়েও অনেক বেশী।
রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে জাতিগত সংঘাত কিংবা ধর্মীয় বিদ্বেষকে দায়ী করা হলেও; বিশ্লেষকরা মনে করেন এর পেছনে বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংকটের প্রাথমিক সূচনা ঘটে বার্মিজ বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের তিক্ততার সম্পর্ক থেকে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বেশ কিছু কারণে এই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আরাকানে বিপুল পরিমাণ খনিজ জ্বালানি সম্পদের প্রাচুর্যতা থাকায়, মায়ানমার সরকার ও তার মিত্ররা এই অঞ্চলকে রেহিঙ্গা মুক্ত করতে চায়। রাশিয়া, ভারত ও চীন এই সংকট সমাধানে কার্যকরভাবে এগিয়ে আসেনি। সংকট সমাধানে গঠিত আনান কমিশনের সুপারিশগুলো মোটেও মেনে চলছে না মায়ানমার। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সাথে মায়ানমার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও; চুক্তি বাস্তবায়নে মায়ানমার সরকারের সদিচ্ছার অভাব দেখা যাচ্ছে। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করা হলেও, দুই বারই সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মায়ানমারের পরম বন্ধু চীনের মধ্যস্থতায় এই সঙ্কট সমাধানের নামে একধরনের কূটনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হয়। কারণ চীন নিজেই জাতিগত নিধনের জন্য অত্যন্ত কুখ্যাত ও অভিজ্ঞ এক খেলোয়ার।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা