১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আটকে রাখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে। বাংলাদেশের স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি দেশে ফেরেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার এ মহান স্থপতি। মৃত্যুর প্রহর গোনা সাড়ে নয় মাসের নিঃসঙ্গ কারাজীবন শেষে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে টালবাহানা করতে থাকে। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীরা শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পূর্ব পরিকল্পিত বাঙালী নিধনযজ্ঞ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে তারা বঙ্গবন্ধুকে তার ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হবার ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষনা দিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মিনওয়ালি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠের নির্বাচিত নেতা হিসেবে কারাগারে তাকে প্রাপ্য সম্মান ও সুবিধাটুকুও দেয়া হয়নি।
কারারুদ্ধ অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। পাকিস্তানের বর্বর হত্যাযজ্ঞের কোনো কিছুই তাকে জানতে দেয়া হয়নি। কোন চিঠিপত্র, খবরের কাগজ তার কাছে পৌছায় নি। তাকে কোনো রেডিও শুনতে দেয়া হয়নি। এমনকি কারাগারের জেলারের সাথেও তার আলাপ নিষিদ্ধ ছিলো। বাঙালীরা যখন প্রাণপনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তখন তাদের অবিসংবাদিত নেতা পাকিস্তানের কারাগারে বসে প্রহসনের বিচারে ফাঁসীর আসামি হিসাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খোড়া হয়েছিলো।
যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তৎকালীন প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে উঠতে থাকে। ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্রমবর্ধমান জনমত ও বিশ্বনেতাদের চাপের মুখে পড়ে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন অন্যায় ভাবে কারাগারে আটকে রাখার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়। এদিন খুব ভোরে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং বিমানের গোপন ফ্লাইট বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লন্ডনের উদ্ধেশ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করে। সেদিন সকাল ৬টা ৩০মিনিটে বিমানটি লন্ডন হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌছানোর মাধ্যমে একটি শ্বাসরুদ্ধকর অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
লন্ডনে পৌছে বঙ্গবন্ধু হোটেল ক্ল্যারিজেস এর ১১২ নং স্যুটে অবস্থান করেন। এখানে পৌছার পর থেকে তার কাছে একের পর এক টেলিফোন আসতে থাকে। সকাল সাড়ে দশটায় কলকাতা বাংলাদেশ মিশন থেকে প্রথম টেলিফোন আসে। এরপর দিল্লী থেকে ইন্দিরা গান্ধী ও দশ নং ডাউনিং স্ট্রিট থেকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁর সাথে টেলিফোনে আলাপ করেন। মুহূর্তের মধ্যেই ক্ল্যারিজেস হোটেলের বিলাস বহুল স্যুট টি যেনো বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীতে পরিণত হয়।
৯ জানুয়ারী দেশের পথে যাত্রা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারী সকালে দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে তাকে অভিবাদন জানাতে উপস্থিত হন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সহ প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩ প্রধান ও কূটনৈতিক মিশনের সদস্য বৃন্দ। ভারতের এ প্রাণঢালা সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু বিমোহিত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক ২৩ দিন পর ১৯৭২ সালে ১০ই জানুয়ারী দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রাণের বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাঙালীরা তাকে বরণ করে নেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো। এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত লোকে লোকারন্য। লোকের ভীড় ঠেলে এতটুকু পথ যেতে তার সময় লাগে ৩ ঘন্টা। সেদিন বিকেল ৫ টায় রেসকোর্স ময়দানে ভাষন দিতে গিয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের মাঝে ফিরে পাবার পরই যেনো বাঙালীদের বিজয়ের আনন্দ পূর্ণতা পায়।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা