বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ইন্টারনেটের সাহায্যে যুক্ত রয়েছে। অতীতের যেকোন ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমের তুলনায় ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সবচেয়ে সাশ্রয়ী, দ্রুততম ও সর্বাধিক কার্যকরী ব্যবস্থা।
ভয়েস কল, ভিডিও কল বা ছবি আদান প্রদান সহ বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য মোবাইল অপারেটর কম্পানিগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে থাকে। কিন্তু ফেসবুক এসব প্রাথমিক সেবা সহ অসংখ্য সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে কিভাবে দেয় এবং কেন দেয় তা জানব এই পর্বে।
বর্তমানে বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রায় ২৫০ কোটি। ২০০০ সালেও বিশ্বব্যাপী এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ কোটি। গত এক দশকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৮ গুণ। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্ক যাকারবার্গ ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১০ সালের পর থেকে ফেসবুক ইন্টারনেট ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থান করে আসছে। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সর্বাধিক মানবীয় যোগাযোগ করা হয়ে থাকে এই ওয়েবসাইটটির মাধ্যমে।
বর্তমানে পৃথিবীর প্রতি ৬ জনে ১ জনের ফেসবুক একাউন্ট রয়েছে। শুধু ফেসবুকের কারণেই বিশ্বে প্রতিদিন ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। “পৃথিবীর সকল ধরনের ইন্টারনেট কার্যক্রমের ২০ শতাংশই হয়ে থাকে ফেসবুকে। অনেকের কাছেই এখন ইন্টারনেট আর ফেসবুকের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই। উন্নয়নশীল দেশের অনেকেই ইন্টারনেট বলতে শুধু ফেসবুককেই বোঝেন।” [তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট]
ফেসবুকে অসংখ্য ছবি আপলোড করা থেকে শুরু করে, ভয়েজ কল, ভিডিও কল বা ফেসবুক লাইভ এর মত সকল সেবা এর ব্যবহারকারীরা বিনামূল্যে পেয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এসব সেবা মোটেও ফ্রি নয়। আমরা এসব সেবার মূল্য পরিশোধ করি আমাদের অমূল্য সম্পদ আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে। আমরা কোন পেজ লাইক করি, কোন গ্রুপে যুক্ত হই, কাকে মেসেজ করি, কি মেসেজ করি, আমাদের মেসেজ ও ফেসবুক স্টেটাস আপডেট এর প্রতিটি শব্দ ফেসবুক সংগ্রহ করে। আমাদের ব্যাপারে সংগৃহিত সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে ফেসবুক আমাদের সম্পর্কে এক বিস্তারিত প্রোফাইল তৈরী করে। আমাদের রুচি, পছন্দ, অভ্যাস, চাহিদা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত আমাদের প্রোফাইলগুলো ফেসবুক বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বেচে দেয়। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের এসব প্রোফাইলের মধ্য থেকে বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের কাঙ্খিত গ্রাহকদের কাছে তাদের বিজ্ঞাপন পৌছায়। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে যারা পন্য ক্রয় করে থাকে, ফেসবুক তাদের কাছে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। এটি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে সফল, কার্যকর ও আগ্রাসী বিজ্ঞাপন প্রচার ব্যবস্থা।
ফ্রি সেবা দেওয়ার মাধ্যমে ফেসবুক প্রথমে বিপুল সংখ্যক নিয়মিত ব্যবহারকারী সংগ্রহ করে, এরপর এসব ব্যবহারকারীদেরকে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বেচে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এটিই ফ্রি ইন্টারনেট মডেল। আমরা যখন ফেসবুক চালাই তখন আমরা আসলে ভোক্তা নই, আমরাই পণ্য।
ফেসবুক এর সবচেয়ে বড় সমস্যাই হল এটি সম্পূর্ণ ফ্রি। আর তাই ফেসবুকের ব্যয়ভার বহন ও মুনাফা অর্জনের জন্য সম্পূর্ন বিজ্ঞাপনদাতাদের উপর নির্ভর করতে হয়। বিজ্ঞাপনদাতারা চায় ভোক্তার আচরণ সম্পর্কে সর্বোচ্চ তথ্য জানতে। ফেসবুক প্রতিদিন প্রায় দেড়শ কোটিরও বেশি লোকের দৈনন্দিন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। আর তাই এই ফ্রি সেবা পাওয়ার বিনিময়ে আমরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে আছি।
“ফেসবুক মানুষের ইতিহাসে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে নিয়োজিত সবচেয়ে ঘৃণাব্যঞ্জক হাতিয়ার। ফেসবুক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য তথ্যের এক বিশাল ভান্ডার।” – জুলিয়ান অস্যাঞ্জ, উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা।
মার্কিন গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তথ্যের এ উৎস নিয়মিত ব্যবহার করছে। এর ফলে ফেসবুক ক্রমেই জনগণের জন্য অনিরাপদ, ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক এক মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের মূল্য কত জানেন? মাত্র ১২ ডলার যা প্রায় ১ হাজার টাকা সমমূল্যের। আমাদের ব্যক্তিত্ব, আগ্রহ, রুচি-পছন্দ, পারিবারিক সম্পর্ক, গোপনীয়তা ইত্যাদির মূল্য টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। অথচ আমরা মাত্র ১ হাজার টাকার সেবা ফ্রি তে পাওয়ার বিনিমিয়ে আমাদের এসব অমূল্য সম্পদ তথ্য ফেসবুককে দিয়ে দিচ্ছি।
বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ কোটির বেশি। এর মধ্যে ১০০ কোটিরও বেশি লোক শুধু স্মার্টফোনের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করে।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা