কম্বোডিয়ায় অবস্থিত মধ্যযুগের এক বিষ্ময়কর স্থাপনা অ্যাংকর ওয়াত। অ্যাংকর ওয়াত অর্থ পবিত্র শহর। এই অ্যাংকর মন্দির কে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল মন্দির কেন্দ্রিক সভ্যতা। এসব মন্দির শুধুমাত্র উপাসনালয় হিসেবে নয়, স্বয়ং দেবতাদের বাসস্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ অ্যাংকরের রাজারা নিজেদেরকে দেবতা হিসেবে দাবি করত। অষ্টম শতক থেকে ১৩ শতক পর্যন্ত সময়টা ছিল এই সভ্যতার স্বর্ণযুগ। একসময় জঙ্গল পরিষ্কার করে যে নগর গড়ে উঠেছিল, কালের বিবর্তনে সেই শহর আবার হারিয়ে যায় জঙ্গলের গহীনে।
কিকেনকিভাবে র এই পর্বে জানব মধ্যযুগের এক জঙ্গল রাজ্য অ্যাংকর ওয়াত সম্পর্কে।
খ্রিষ্টিয় প্রথম শতক থেকে এই অঞ্চলে খেমার জাতীগোষ্ঠী বসবাস করত। অষ্টম শতকে খেমারদের মধ্যে এক মহান রাজার উত্থান ঘটে। এই রাজার অধীনে তার প্রজারা পূর্ব কম্বোডিয়া ছেড়ে, মিকং নদী অতিক্রম করে এক নতুন পবিত্র স্থানের দিকে যাত্রা শুরু করে। ৮০২ সালে এই গোত্রপতি জয়বর্মন নাম ধারণ করে সিংহাসন আরোহনের পাশাপাশি, খেমারদের দেবতা রূপে আসীন হন। এর পরবর্তী ৫০০ বছর, জয়বর্মনের উত্তরসূরীরা জীবন্ত দেবতা হিসেবে এ অঞ্চল শাসন করেছে। এই সা¤্রাজ্যের সীমানা ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে লাওস এবং মিকং নদী থেকে পূর্ব বার্মা পর্যন্ত। ৯ম থেকে ১৫ শতকের মধ্যে সর্বমোট ৩৮ জন রাজা এই সা¤্রাজ্য পরিচালনা করে। ধারণা করা হয় এই সভ্যতার অধীনে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের বসবাস ছিল। ১১ থেকে ১৩ শতকের মধ্যে অ্যাংকর ছিল পৃথিবীর অন্যতম বড় শহর।
খেমাররা তাদের নতুন ভূখন্ডে আসার পর থেকেই, জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে এক পবিত্র নগরী গড়ে তুলতে থাকে। বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জন্য তারা বন নিধন করে চাষাবাদ শুরু করে। ১২ শতকের দিকে অ্যাংকরের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা সপ্তম জয়বর্মন অ্যাংকরের এই শহরকে অনেকটা পূর্নাঙ্গ রূপ দেয়। তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল যেখানে কেবল মাত্র খাল খননের পদ্ধতি শিখছিল, সেময়ে খেমাররা খাল খননের বিদ্যায় অবস্থান করছিল সবার শীর্ষে। আন্ত সংযুক্ত জলপথ এবং ছোট বড় বহু চ্যানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল পুরো শহর। এসব খালের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত পানি, খাবার, রান্নার এবং গোসলের কাজে ব্যবহার করা হত। কেন্দ্রীয় রাজধানীর সাথে প্রায় ৩ হাজার গ্রাম সংযুক্ত ছিল। এসব গ্রাম থেকে বিপুল পরিমাণ রসদ কেন্দ্রে পরিবহনের জন্যও ছিল পরিকল্পিত রাস্তা ও জলপথ। চতুর্ভুজাকৃতির দেয়ালে ঘেরা এই অঞ্চলটি ছিল এক পবিত্র শহর। তৎকালীন সময়ে অ্যাংকর ছিল ইউরোপের যেকোন শহরের তুলনায় অনেক বড় এবং বহুগুণ আধূনিক।
অ্যাংকর ওয়াত এর মূল আকর্ষণ হল এর রাজধানীর কেন্দ্রিয় মন্দির। রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মন এই মন্দির নির্মান করেন বলে ধারণা কর হয়। এই মন্দিরটি এতটাই সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় যে, কম্বোডিয়ার জাতীয় পতাকায় এই অ্যাঙ্কর মন্দিরের নকশা অঙ্কিত রয়েছে। কোন দেশের জাতীয় পতাকায় স্থান পাওয়া এটিই একমাত্র ভবন। এই স্থাপনাটি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত, একটি অংশ পর্বতের মত এবং আরেকটি অংশ গ্যালারির মত। মন্দিরের চারপাশে রয়েছে চতুর্ভুজাকৃতির পরিখা। মন্দির নির্মানের মূল ধারণা গ্রহণ করা হয়েছে হিন্দু দেবতাদের পৌরাণিক আবাসস্থল থেকে। হিন্দুধর্মের তিনজন প্রধান দেবতা হলেন- শিব, বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা। এর মধ্যে বিষ্ণু ‘রক্ষক’ বা ‘প্রতিপালক’ হিসেবে পরিচিত। তার প্রতি উৎসর্গ করেই এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। আয়তনের দিক থেকে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মন্দির। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে অতীতের খেমার রাজ্যের রাজধানী গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে এই মন্দিরটি কম্বোডিয়ার প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপে অবস্থিত এই মন্দিরে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি পর্যটক ভ্রমণ করতে আসে। ১৯৯২ সালে মন্দিরটি ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
কেন্দ্রিয় মন্দির নির্মানকারী রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মন ছিল দেবতা বিষ্ণুর পরম ভক্ত। তিনি সবসময় বিষ্ণুদেবের পূজা করতেন, তাই অ্যাঙ্কর ওয়াতের কেন্দ্রীয় মিনারে একটি বিষ্ণু মূর্তি স্থাপন করা হয়। স¤্র্ট দ্বিতীয় সূর্যবর্মনের বিষ্ণুভক্তির জন্য তার মৃত্যুর পর তাকে ‘পরমবিষ্ণুলোক’ উপাধি দেওয়া হয়। ‘পরমবিষ্ণুলোক’ অর্থ যে ব্যক্তি বিষ্ণু দেবের সর্বোত্তম গৃহে বাস করে। দ্বিতীয় সূর্যবর্মন ছাড়াও অ্যাংকরের অন্যান্য রাজারাও বিভিন্ন দেবতার চমৎকার সব মন্দির নির্মান করেন। এসব মন্দির নির্মানের মাধ্যমে তারা প্রজাদের বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে, দেবতারা তাদের রাজার উপর সন্তুষ্ট। যদিও এসব মন্দির শুধুমাত্র উপাসনালয় হিসেবেই নয়, বরং দেবতাদের আবাস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হত। কারণ অ্যাংকরের রাজারা নিজেদেরকেও দেবতা হিসেবে দাবি করত। প্রত্যেক রাজার নিজের সম্মানে তৈরী করা মন্দির, মৃত্যুর পর তাদের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে কাজ করত। অ্যাংকরের দেবতা রাজারা এই মন্দিরেই বসবাস করত, এবং প্রতিবছর শুধুমাত্র নববর্ষের উৎসব ব্যতিত রাজারা এই মন্দিরের বাইরে যেত না। কেন্দ্রীয় মন্দিরে কমপক্ষে ১২ হাজার লোক বসবাস করত। মন্দিরের আচার অনুষ্ঠান পালনের জন্য ছিল বহু সংখ্যক পুরোহিত এবং প্রায় ৬৫০ জন নর্তকী। মন্দিরে সবসময় রাজার ৫ জন স্ত্রী থাকত, এবং তার হারেমে ছিল ৩ হাজার নারী। রাজ্যের সকল পরিবার থেকে একজন নারী এই হারেমে অবস্থান করত, যা সমগ্র রাজ্যের সাথে রাজধানীর প্রত্যক্ষ সেতুবন্ধন হিসেবে গণ্য করা হত। এছাড়া বাকি কয়েক হাজার লোক মন্দির রক্ষণাবেক্ষনের কাজে জড়িত ছিল।
খেমারদের অর্থনীতি ছিল আন্তর্জাতিক বানিজ্য নির্ভর। প্রচুর শষ্য উৎপাদনের পাশাপাশি, তারা উন্নত বস্ত্র, ব্রোঞ্জের মূতি, হাতির দাত এবং সুগন্ধী কাঠ রপ্তানি করত। তাদের প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল চীনারা। সেসময় কম্বোডিয়ায় নারীরা ব্যবসার মূল দ্বায়িত্ব পালন করত। সম্পত্তির মালিকানাও ভোগ করত নারীরা। বানিজ্য করতে আসা বহু চীনা নাগরিক খেমার নারীদের বিয়ে করে এখানে বসবাস করত। ১২৯৬ সালে জো ডা গুয়াং নামের এক নি¤œ পদস্থ চৈনিক কর্মচারী সরকারী সফরে অ্যাংকর ভ্রমন করেন। তার দীর্ঘ ভ্রমণলিপিতেই মূলত এই সভ্যতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রতœতাত্ত্বিকেরা জো ডা গুয়াংয়ের বর্ণনা অনুযায়ী সেই হারানো শহরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করেন।
খ্রিষ্টীয় ২য় শতক থেকে খেমার জনগন হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিল। কয়েকশ বছর শাসন করা হিন্দু রাজাদের পরে, রাজা সপ্তম জয়বর্মন বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তিরিত হবার পর থেকে, খেমার জনগণ তাদের রাজার প্রভূত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করে। তখন থেকেই তারা রাজাদের অতি উচ্চাভিলাসের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। কারণ, হিন্দু থাকাকালীন বর্ণপ্রথা অনুযায়ী তাদের সমাজে ৪ টি ভাগ ছিল। সেসময় সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অনেক বেশি, তারপর ছিল ক্ষত্রিয়দের অবস্থান। বৈশ্যদের প্রতিপত্তি সামান্য কিছুটা থাকলেও, সবচেয়ে অবহেলিত ছিল শূদ্ররা। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মে এরকম বর্ণবিভাজন না থাকায়, সবাই এক কাতারে চলে আসে। এর ফলে অ্যাংকরের আভিজাত শ্রেণীর পতন ঘটতে থাকে। ধর্মীয় রীতিনীতির বদল হওয়াতেই একসময় সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তী সময়ে অ্যাংকরের সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মধ্যযুগের এই পরিকল্পিত নগর সভ্যতা বিভিন্ন কারণে ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। তৎকালীন সময়ে একাধিক বিশাল নির্মানযজ্ঞের কারনে, রাষ্ট্র হিসেবে অ্যাংকর নিশ্বেষ হতে শুরু করে। এই সভ্যতার গোড়া পত্তন করতে গিয়ে এত বিপুল পরিমান বননিধন করা হয়, যে এক সময় তা প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের ধ্বংস ডেকে আনে। ফলে ক্রমশই তাদের সম্পদ ফুরিয়ে যেতে থাকে। এছাড়া ভিয়েতনামী চ্যাম রা ছিল খেমারদের জাত শত্রু। অ্যাংকর শহরের দেয়ালগুলোতে চ্যামদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধের চিত্র অঙ্কিত রয়েছে। সেসব যুদ্ধে অ্যাংকরের ক্ষতি হলেও, পুরোপুরি বিনাশ ঘটেনি। কিন্তু থাই সায়াম স¤্রাজ্য খেমারদের জন্য নতুন হুমকি হিসেবে আর্বিভূত হয়। সামরিক দুর্বলতা, ও শৃঙ্খলার অভাবে ১৪৩১ সালে খেমাররা সায়ামদের কাছে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে। এরপর ধীরে ধীরে অ্যাংকর ওয়াতকে গ্রাস করে নেয় কম্বোডিয়ার রেইনফরে
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা