১ম বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার ২১ বছরের মাথায় বিশ্ববাসী আরেকটি মহাযুদ্ধের মুখোমুখি হয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ ছিল আরো ভয়াবহ ও বিধ্বংসী। মূলত ১ম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াই ২য় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। ১ম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মিত্রশক্তি কর্তৃক জার্মানিসহ পরাজিত দেশগুলোর উপর ভার্সাই চুক্তিসহ বিভিন্ন শর্ত জোরপূর্বকভাবে আরোপ করা হয়। সেই সময়ে পরাজিত জার্মানি ও কেন্দ্রীয় শক্তির দেশগুলোর পক্ষে এসব অপমানজনক ও জোরজবরদস্তি মূলক সন্ধির শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। সেসব অসম্মানজনক চুক্তিগুলোই মূলত ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রধানতম কারন হিসেবে বিবেচিত। জার্মানির নাৎসী নেতা হিটলার প্রথম থেকেই এইসব অন্যায় দাবির বিরোধিতা করেছিলেন। পরে তাঁরই নেতৃত্বে জার্মানি প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চেষ্টাতে জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হলেও মার্কিন সিনেট তার অনুমোদন করেনি। ফলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হাতে জাতিপুঞ্জের দায়িত্ব থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত বৃহৎ রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে তারা বিশ্ব উত্তেজনা প্রশমন কিংবা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। তখন জার্মানি, ইতালি ও জাপানের কোন উপনিবেশ ছিলনা। তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্যে এই দেশগুলি উপনিবেশ দখলের চেষ্টা শুরু করলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আর এই উত্তেজনা সৃষ্টিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনেকাংশে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন-ফ্রান্সের মধ্যকার মতবিরোধকেও অনেক বিশ্লেষক ২য় বিশ্বযুদ্ধের একটি কারন বলে মনে করেন। এছাড়াও ইটালির ফ্যাসিবাদ ও জাপানের সমরবাদ নীতিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। এই সব দেশের শাসকগোষ্ঠী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের নেশায় মেতে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া, নানকিং, পিকিং সহ বহু শহর দখল করে। ইটালি ১৯৩৮ সালে আবিসিনিয়া দখল করে। জার্মানি নতুন করে সাম্রাজ্য বিস্তারে দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠে। রাশিয়াও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো দখলের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের পথ খুঁজছিল। পরাশক্তি দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদারিত্ব মনোভাব ২য় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোযোগী জার্মানি ও ইটালিকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স উল্টো তাদের প্রতি তোষণনীতি গ্রহণ করে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণ নীতি নাৎসি নেতা হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। বেপরোয়া জার্মানি রাইন ভূখন্ড, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া প্রভৃতি দেশগুলো আক্রমণ করে দখলে নিতে থাকে। যা ২য় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা মঞ্চ তৈরী করে। সাংগঠনিক ক্রুটি, নেতৃত্বের দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারনে বিশ্বশান্তি রক্ষা কিংবা সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার বন্ধ করার ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জ কার্যকর কোন পদক্ষেপে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে জার্মানি, ইতালি, জাপান আক্রমণাত্মক ও দখলদারীত্ব মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করে যা বিশ্বকে আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। ১৯৩৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইটালির মধ্যস্থতায় জার্মানির মিউনিখ শহরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা মিউনিখ চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুসারে চেকোশ্লোভাকিয়ার সুদাতেন অঞ্চল জার্মানিকে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তার বিনিময়ে হিটলার চেকোশ্লোভাকিয়ার বাকি অংশে আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মিউনিখ চুক্তির মাত্র সাত মাস পর ১৯৩৯ সালের ১৫ মার্চ হিটলার সমগ্র চেকোশ্লোভাকিয়া আক্রমণের মাধ্যমে দখল করে। রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি কিংবা পোল্যান্ডের ডানজিগ বন্দরের দাবি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ ২য় বিশ্বযুদ্ধের আরেক পটভূমি তৈরি করেছিল। আসন্ন পোল্যান্ড আক্রমণের সম্ভাবনায় ব্রিটেন-ফ্রান্স-পোল্যান্ডের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যার মাধ্যমে পরস্পরকে সরাসরি সামরিক সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এসময় জার্মানির প্রতি তোষণ নীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এবং এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। বিশ্বের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বিপরীত দুটি সামরিক জোটে বিভক্ত হয়ে এই যুদ্ধে যোগদান করে। মিত্রশক্তি নামক সামরিক জোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডার মত বিভিন্ন পরাশক্তিধর দেশগুলোর অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে জার্মানি, জাপান, ইতালি, রোমানিয়ার মত দেশগুলো নিয়ে অক্ষশক্তি গঠিত হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে অক্ষশক্তি বিশেষ করে জার্মানি ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা নিজেদের দখলে নেয়। অন্যদিকে জার্মানির মিত্রদেশ জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন ও ইউরোপীয় উপনিবেশসমূহ আক্রমণ করে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের বেশিরভাগ অঞ্চল জয় করতে সক্ষম হয়। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে মার্কিন নৌঘাটি পার্ল হারবারে হামলা করে। এই হামলার প্রেক্ষিতেই মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই মহাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ অক্ষশক্তির জয়রথ থামিয়ে পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে হিটলারের ভুল রণকৌশলের কারনে জার্মানি ১৯৪৩ সালে স্টালিনগ্রাদ যুদ্ধে আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন ডি ডে যুদ্ধে ব্রিটেন, কানাডা, মার্কিন যৌথবাহিণীর আক্রমণের মধ্য দিয়ে জার্মানির দখলকৃত ফ্রান্স-কে পুনরায় স্বাধীন করা হয়। ১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মানি চূড়ান্তভাবে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয়। পার্ল হারবার আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগষ্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এই পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের ফলে দুটি এলাকা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় এবং প্রায় চাল লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পর ১৯৪৫ সালের ১৪ আগষ্ট ধ্বংসপ্রাপ্ত জাপান, মিত্রশক্তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়।
বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী। এই যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া বিশ্ব পরাশক্তির মর্যাদা লাভ করে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশগুলোর স্থান হয় দ্বিতীয় সারিতে। ইতালিতে ফ্যাসিবাদী সরকারের জায়গায় প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী আদর্শ পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বপ্রথম রাশিয়ার সাম্যবাদী আদর্শ জয়যুক্ত হয়। পরবর্তীতে চীন, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি ইত্যাদি দেশ সাম্যবাদী আদর্শ গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি এবং তাঁদের মিত্র দেশগুলি। অন্যদিকে রাশিয়া, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ। এভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত দেশগুলির মধ্যে এক ধরণের স্নায়ুর লড়াই শুরু হয় যাকে স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ভারত, নাইজেরিয়া, যুগোস্লাভিয়ার মত দেশগুলো জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর উপনিবেশ দেশগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র যুক্ত হতে শুরু করে। এর মধ্য ভারত, পাকিস্তান, কোরিয়ার মত দেশগুলো অন্যতম। বিধ্বস্ত ইউরোপ পুনর্গঠনের লক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল প্লান গ্রহণ করে। ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো নামক সামরিক জোট গঠন করা হয়। মূলত ইউরোপে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের স্বার্থেই র্শাল প্লান, ন্যাটো গঠন সহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি দুইটি দেশে বিভক্ত হয়। আবার কোরিয়া বিভক্ত হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া নামক পৃথক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে মূলত মার্কিন ও সোভিয়েত প্রভাবিত সরকার দেশ পরিচালনা করতে শুরু করে। ২য় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ গঠন করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে দ্বিমেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব হয়। যা পরবর্তীতে কিউবার মিসাইল সংকট, কোরিয়া সংকট কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে খুঁজতে থাকে এটম বোমা বা পারমানবিক বোমা তৈরির কৌশল। আমেরিকানরা তখনও খুব শঙ্কিত ছিল এই ভেবে যে, জার্মানরা হয়ত যে কোন মুহুর্তে পারমানবিক বোমা আবিষ্কার করে ফেলতে পারে। পরবর্তীতে আমেরিকানরাই প্রথম পারমানবিক বোমা তৈরী করে পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসকেই বদলে দেয়।
মানব ইতিহাসের সবচাইতে শক্তিশালী মারণাস্ত্র, পারমানবিক বোমা কিভাবে আবিষ্কার হল, তা জানতে কি কেন কিভাবে র এই ভিডিওটি দেখুন। কি কেন কিভাবে চ্যানেলে আপনি নতুন হলে এই চ্যানেলের অন্যান্য ভিডিওগুলোও দেখতে থাকুন।
এ ধরনের ভিডিও নিয়মিত দেখতে চাইলে কি কেন কিভাবে সাবস্ক্রাইব করুন, আমাদের পরবর্তী ভিডিও আপলোড হওয়ার সাথে সাথে দেখতে চাইলে সাবস্ক্রাইব বাটনের পাশে বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।
এই ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক করুন, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আমাদের চ্যানেলে কি কি ধরনের ভিডিও দেখতে চান তা কমেন্টে লিখে জানান।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা