হিন্দু দেবী দুর্গার উপাসনা কে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব হল দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব। দুর্গাপূজা সকল হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত হলেও, বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। সাধারণত আশ্বিন বা চৈত্র মাসে দুর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিন মাসের পূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা এবং চৈত্র মাসের পূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। তবে শারদীয় দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি।
কিকেনকিভাবে র এই পর্বে জানব বাঙালী হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা সম্পর্কে।
ভারতীয় উপমহাদেশের এক আধ্যাত্মিক মতবাদ হল হিন্দুধর্ম। একাধিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত এই আচার সনাতন ধর্ম নামেও পরিচিত। বহু উৎস থেকে উৎপত্তি হওয়ায়, হিন্দু ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই। জনসংখ্যার বিচারে খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের পর হিন্দু বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ১৩৫ কোটি হিন্দু ধর্মাবলম্বী রয়েছে। এদের মধ্যে ১১০ কোটি হিন্দু শুধুমাত্র ভারতে বসবাস করে। হিন্দু ধর্মের বহু সংখ্যক দেব-দেবী আছে। তাদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় এক দেবী হল দুর্গা; যার অর্থ “যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন”। হিন্দুরা তাঁকে মহাশক্তির একটি উগ্র রূপ মনে করেন। দুর্গার অন্যান্য নামগুলো হল চ-িকা, যোগমায়া, অম্বিকা, মহামায়া, বৈষ্ণবী, নারায়নী, মহিষাসুরসংহারিণী ইত্যাদি। দুর্গা পুজার মূল উৎস হল সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র বেদ। দেবী দুর্গার ১০টি হাত আছে; তাই তাকে বলা হয় দশভূজা। এই দশটি হাত দশ দিক রক্ষা করার প্রতীক। তবে শাস্ত্র অনুসারে তাঁর চার, আট, দশ, ষোলো, আঠারো বা কুড়িটি বাহু থাকতে পারে। দুর্গার তিনটি চোখ আছে; একটি চোখ চন্দ্রের প্রতীক, একটি সূর্যের প্রতীক এবং তৃতীয়টি অগুনের প্রতীক। দুর্গা দেবীর বাহন হল সিংহ, আবার কোনো কোনো মতে প্রানীটি হল বাঘ। দুর্গার সবচেয়ে জনপ্রিয় মূর্তিতে তাঁকে মহিষাসুর নামের এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়।
হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, মহিষাসুর নামের এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করে ফেলে। তখন রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার শক্তি থেকে জন্ম লাভ করে দুর্গা। দেবতাদের শক্তিতে বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করে। তাই দেবীর একটি নামই হল মহিষমর্দিনী। এছাড়া হিন্দু বিশ্বাস মতে দুর্গা, দেবতা শিবের স্ত্রী এবং কার্তিক ও গণেশের মা। দুর্গাপূজার প্রচলন সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে লিখিত আছে যে, সৃষ্টির আদিতে মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর দ্বিতীয়বার ব্রহ্মা, তৃতীয়বার মহাদেব এবং চতুর্থবার ইন্দ্র দুর্গার শরণাপন্ন হন। এছাড়া জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ঋষি মান্ডব্য, হারানো রাজ্য ফিরে পেতে সুরথ রাজা এবং বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দুর্গার আরাধনা করেন। পূজায় তুষ্টা দেবীর বরে তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এই পূজাগুলো বসন্তকালে হয়েছিল বলে এর আরেক নাম ‘বাসন্তী’ পূজা। কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে জানা যায় যে, রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে বা, শরৎকালে দেবীর পূজা করেছিলেন। তখন থেকে এই পূজার আরেক নাম হয় অকালবোধন। রামচন্দ্রের অকালবোধন থেকে অনুপ্রণিত হয়েই পরবর্তীতে বাংলা অঞ্চলে শারদীয় দুর্গোৎসব জনপ্রিয়তা লাভ করে।
দুর্গার আরাধনা বাংলা, আসাম, ওড়িশা, ঝাড়খ- এবং বিহার অঞ্চলে অধিক প্রচলিত। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে দুর্গাপূজা নবরাত্রি উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। এছাড়া হিন্দুপ্রধান দেশ নেপালেও এটিই সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। একাধিক হিন্দু প্রচার গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, দশম বা একাদশ শতকে দূর্গা পুজার সূচনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণে দুর্গা পূজার কোন উল্লেখ ছিল না। কিন্তু কৃত্তিবাস ওঝা বাংলায় রামায়ন অনুবাদ করার সময়, লোকায়ত দুর্গার গল্প রামায়নে অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর বাঙালী হিন্দুরা মনে করে, যে দুর্গার সাহায্যে রামচন্দ্র রাবণকে বধ করতে পারে, সেই দুর্গা তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনেও কাজে আসবে। আর তখন থেকেই বাঙালী হিন্দুদের কাছে দুর্গা প্রধানতম দেবী হিসেবে আবির্ভুত হয়। কিন্তু তারপরও দুর্গাপূজা বাঙালী হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হতে আরো কয়েকশ বছর সময় লেগেছে। আনুষ্ঠানিকতা ও জাঁকজমকের সাথে এই পূজা আর্চনা শুরু হয় প্রায় সাড়ে ৫শ বছর আগে। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম দুর্গা পূজা যেখানে হয়েছিল সেই অঞ্চলটি বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ তাঁর পারিবারিক মন্দিরেই প্রথম মহাআড়ম্বরের সাথে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন।
মূলত ব্রিটিশ শাসনের সময় হিন্দু এলিট ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দুর্গা পূজা। দুর্গা পূজার সময় হিসেবে শরৎ কালকে বেছে নেবার আরেকটি কারণ হল, এই সময়টাতে খুব একটা বৃষ্টি হয় না। তাছাড়া এটি নবান্নের সময় হবার কারণে, এ সময় ধান ও অন্যান্য শস্য বাঙালীর ঘরে উঠত, সেইসাথে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো থাকত। সকলে মিলে মিশে এই সময়টাতে আনন্দ করতে পারতো। ফলে দ্রুত বাঙ্গালী হিন্দুরা দুর্গা পুজাকে সাদরে গ্রহণ করে। এবং ক্রমেই অন্যান্য দেব দেবীর পূজাকে ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে দুর্গার উৎসব। ভারত ও বাংলাদেশের সর্বত্রই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজা কেউ ব্যক্তিগতভাবে করে, কেউবা সমষ্টিগতভাবে। সমষ্টিগত পূজাকে বলা হয় বারোয়ারি পুজো বা সর্বজনীন দুর্গোৎসব।
পূজা পালনের সময় অনুযায়ী দুর্গাপূজা প্রধানত ২ প্রকার। যেমন, বাসন্তী পূজা ও শারদীয় পূজা। বাসন্তী পূজা হয় চৈত্রের শুক্লপক্ষে, আর শারদীয়া পূজা হয় সাধারণত আশ্বিন অথবা কার্তিকের শুক্লপক্ষে। দুর্গাপূজা পালনের আচার অনুযায়ী তিন প্রকার। যেমন, সাত্ত্বিক, তামসিক ও রাজসিক। প্রথা অনুযায়ী দুর্গোৎসব কখনো পাঁচ, দশ বা পনেরো দিনের হয়। দুর্গা পূজার শুরু হয় মহালয়ায়। এর ঠিক পাঁচদিন পর মহাষষ্ঠীতে হয় বোধন, আমন্ত্রন ও অধিবাস। মহাসপ্তমীতে হয় ‘নবপত্রিকা’ বা প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে ‘কলাবউ’ পূজা। মহাঅষ্টমীতে হয় কুমারী পূজা। বৃহদ্ধর্মপুরাণের মতে, দেবী দূর্গা কুমারী কন্যারূপেই দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। তবে সব পূজা মন্ডপে কুমারী পূজার প্রচলন নেই। বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের শুধু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পূজামন্ডপগুলোতে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মহানবমীতে হয় বিহিত পূজা। এবং বিজয়া দশমীতে হয় বিসর্জন। বিজয়া দশমী হল পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিন। হিন্দুরা বিশ্বাস করে, এদিন দেবী মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বর্গ শিখর কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যান।
দুর্গা দেবী সম্পর্কে প্রচলিত এই বিশ্বাস ও আচারের বাইরেও আরেকটি বিশেষ রুপ হল বনদূর্গা। বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসরত হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই এই বনদুর্গার আরাধরনা করে। বনদুর্গা তার মুসলিম অনুসারীদের কাছে বনবিবি নামে পরিচিত। সুন্দরবনের মধু সংগ্রহকারী ও কাঠুরে জনগোষ্ঠী বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করে। বাংলাদেশে ও ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলের লোক সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই বনবিবি। অরন্যচারী মানুষের বিশ্বাস, ভক্তি ও জীবনধারায় বনদুর্গা বা বনবিবি রক্ষাকত্রী হিসেবে বিবেচিত হলেও, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় দেবী তার নিজের আবাসস্থল কেই রক্ষা করতে পারছে না। বিগত দুইশ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একশ বছরের মধ্যে সুন্দরবন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশ বা ভারতের নয়, পুরো পৃথিবীর এক অন্যতম প্রাকৃতিক বিষ্ময়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে কিকেনকিভাবে র এই ভিডিওটি দেখুন।
কিকেনকিভাবে চ্যানেলে আপনি নতুন হলে, আমাদের অন্যান্য ভিডিওগুলোও দেখতে থাকুন।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা