বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর হল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রতিবছর ৬ টি মহাদেশের প্রায় ৯ কোটি যাত্রী এই বিমান বন্দর ব্যবহার করে। দুবাই এর অর্থনীতির ১৫ শতাংশই আসে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে।
কিকেনকিভাবে র এই পর্বে জানব পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সম্পর্কে।
অনেকেই মনে করেন দুবাই হয়ত একটি দেশ; কিন্তু না, দুবাই হল সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক রাজধানী। এই শহরের দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক যাত্রী পারাপার হয়। প্রতিমাসে বিমান বন্দরটি ব্যবহার করে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ যাত্রী বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করে। ২০১৮ সালে প্রায় ৯ কোটি যাত্রী এই বিমান বন্দর ব্যবহার করেছে। এবছর এই সংখ্যা ১১ কোটি ছারিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুবাই বিমান বন্দর থেকে ১০৬ টি বিমান পরিবহন সংস্থা, বিশ্বের ২০৬ টি গন্তব্যে বিমান পরিসেবা পরিচালনা করে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ৯০ হাজার কর্মী বন্দরটি পরিচালনার দ্বায়িত্বে রয়েছে। শুধু বিমান বন্দর হিসেবে নয়, কোন একক কর্মস্থল হিসেবেও দুবাই বিমান বন্দর পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম কর্মস্থল। অত্যাধুনিক সকল প্রযুক্তি, বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতি আর বহু কর্মীর পরিশ্রমে বছরের ৩৬৫ দিনই সচল থাকে এই বিমান বন্দর। ২০১৪ সালে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরকে অতিক্রম করে দুবাই বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দর হিসেবে উঠে আসে। টানা পাঁচ বছর যাবৎ বিমানবন্দরটি এ তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। এবং খুব সহজে নতুন কোন বিমান বন্দর এই তকমা ছিনিয়ে নেবার সম্ভাবনা খুবই কম।
প্রশ্ন আসতে পারে, তুলনামূলক ছোট্ট একটি শহর দুবাইয়ে এত লোক কোথা থেকে আসে? এর উত্তর হল, ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে দুবাই, এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের প্রায় মাঝামাঝি যায়গায় অবস্থিত। সেকারণে এই বিস্তৃণী এলাকার দূরবর্তী ফ্লাইটগুলো দুবাইয়ে তাদের যাত্রাবিরতি করে। এছাড়া দুবাইয়ের নিজস্ব মালিকানায় থাকা দুই শতাধিক বিমান সহ, বহু বিমান সংস্থা খুব সহজেই এই বিমান বন্দর থেকে ট্রানজিট সুবিধা নিতে পারে। শুধু ভৌগলিক কারণেই দুবাই এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, এর জন্য তারা রীতিমত পরিকল্পনা করে, নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছে। বিমান পরিসেবায় একেকটি ফ্লাইটের ট্রানজিটের কারণে, বিমান কর্তৃপক্ষকে বহু টাকা গুনতে হয়। দুবাই কর্তৃপক্ষ তাদের বিমান বন্দরে পর্যাপ্ত সুবিধা রাখার পরও, নানা উপায়ে এই ট্রানজিটের খরচ বহুগুণ কমিয়ে এনেছে। ফলে দুবাই এর আশেপাশে একাধিক বিমান বন্দর থাকলেও, বেসরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলো ট্রানজিট গ্রহণের ক্ষেত্রে দুবাই কেই প্রাধান্য দিচ্ছে। দুবাইয়ের এই পদ্ধতি অনুসরণ করে তুরষ্কও নিজেদেরকে ট্রানজিট হাব হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এবং ইতোমধ্যে তারাও যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে।
বিমান বন্দরের জন্য দুবাই শহরের সাংকেতিক নাম হল DXB। IATA বা আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা বিভিন্ন বড় শহরের বিমান বন্দরগুলোর জন্য এ ধরনের সাংকেতিক নাম প্রদান করে থাকে। যেমন IATA অনুযায়ী ঢাকা শহরের সাংকেতিক নাম DAC এবং কলকাতার সাংকেতিক নাম CCU। সাধারণত এই IATA কোড দ্বারা শহরের প্রধান বিমানবন্দগেুলোকে বোঝানো হয়। DXB বিমান বন্দরে ২টি বিশাল রানওয়ে, ৩টি অত্যাধুনিক টার্মিনাল ও ৪ টি বিশাল ভবন রয়েছে। প্রতিদিন ২ লক্ষাধিক যাত্রীর চাপ সামলাতে তারা যথেষ্ট পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এরপরও প্রতিবছর দুবাই বন্দরের যাত্রীর সংখ্যা ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান যাত্রী সেবা অক্ষুন্ন রাখতে, দুবাই বিমান বন্দর সবার প্রথম পূর্নাঙ্গ স্মার্ট বিমান বন্দর হিসেবে রূপান্তরিত হচ্ছে। বিশেষ ধরনের স্মার্ট টেকনোলজির সাহায্যে বন্দরে প্রবেশ করা সকল যাত্রীর চলাফেরা অনুসরণ করা হয়। বিমান বন্দরের কর্মীরা এই তথ্যগুলো দেখে, সহজেই যাত্রীদের ভিড় সম্পর্কে ধারণা পায়। এই প্রযুক্তির সাহায্যে যাত্রীদের ব্যাগ ও মালামাল কোথায় আছে তাও বলে দেয়া যায়। ভবিষ্যতে এই বন্দরে ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি যুক্ত করা হবে, যা যাত্রীদের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া আরও দ্রত করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে, বিমান ওঠানামার সময় ও যাত্রীদের মালামাল কখন কোথায় থাকবে, তা আগে থেকে বলে দেওয়ার ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হচ্ছে।
প্রতিদিন ৬ টি মহাদেশের প্রায় ২ লক্ষাধিক যাত্রী ও ২০০ টন মালামাল পরিবহন করে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। বন্দরটিতে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার বিমান ওঠা নামা করে। সমগ্র পৃথিবীর লোক একত্রিত হয় এই একটি বন্দরে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই বিমানবন্দর থেকে সবচেয়ে বেশি যাত্রী যাতায়াত করে ভারতে। দুবাই বিমান বন্দরের সাথে সবচেয়ে বেশি ফ্লাইট আদান প্রদান হয় মুম্বাই বিমান বন্দরের সাথে। বিশ্বের সকল প্রান্তের লোক এই বিমান বন্দরে আসে, তাই এখানে চোরাচালানের ঝুঁকিও অনেক বেশি। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১ হাজার ৭শ টি অনিয়মের ঘটনা ধরা পড়ে। মাদক চোরাকারবারীরা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পদ্ধতি বের করে। আর এগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে, বন্দর কর্তৃপক্ষকেও উন্নত করতে হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তির চেয়েও দুবাই কাস্টমস কর্মকর্তাদের দক্ষতার কারনে সবচেয়ে বেশি চোরাচালান ধরা পড়ে। এই বন্দরে সামান্য পরিমাণ মাদক নিয়ে ধরা পড়লে, ৪ বছরের কারাবরণ করতে হয়। আর বানিজ্যিক আকারে মাদকের চালান ধরা পড়লে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
বর্তমানে দুবাই এর অর্থনীতির ১৫ শতাংশই আসে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে। দু এক বছরের মধ্যে এই খাত থেকে ২০ শতাংশ জিডিপি আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবং আগামী কয়েক বছরে দেশটির সমগ্র অর্থনীতির ৪০ ভাগ অর্জনের লক্ষ্যমাত্র নেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র বিমান খাত থেকে। দুবাই বিমান বন্দরের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে আরেকটি নাম, এমিরেটস এয়ারলাইন্স। এটি দুবাই অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব বিমান পরিবহন সংস্থা। বিলাসবহুল এমিরেটস এয়ারলাইন্স তাদের ১১৮ টি বিমান দিয়ে বিশ্বের ৫৫ টি দেশের ৯১ টি গন্তব্যে যাত্রীসেবা প্রদান করে। দুবাই এর সরকারি মালিকানাধীন তুলনামূলক কম খরচের আরেকটি বিমান সংস্থা হল ফ্লাই দুবাই। ৬২ টি বিমানের সাহায্যে বিশ্বের ৯৪ টি গন্তব্যে যাতায়াত করে ফ্লাইদুবাই। এছাড়া দুবাই বিমান বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত আরেকটি প্রতিষ্ঠান হল ইতিহাদ এয়ার ওয়েজ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় বিমান পরিবহন সংস্থা ইতিহাদ, ৬৭ টি বিমানের সাহায্যে বিশ্বের ৫৫ টি দেশের ৮৫ টি গন্তব্যে যাতায়াত করে। এই বিমান সংস্থাগুলো যাত্রী পরিবহনের পাশাপশি বহু পৃথক কার্গো সেবা প্রদান করে থাকে।
দুবাই তার প্রতিবেশী অন্যান্য আমিরাতের মত শুধুমাত্র তেলের টাকায় গড়ে উঠেনি। দুবাই এর মোট রাজস্বের মাত্র ৫ শতাংশ আসে খনিজ তেল শিল্প থেকে। পর্যটন, রিয়েল এস্টেট ও শুল্কমুক্ত ব্যবসায়িক অঞ্চল গড়ে তোলার কারণে এক সময়কার অনুন্নত এই জেলে পল্লী পরিণত হয়েছে বিশ্বের বিলাসবহুল এক শহরে। ১৮৩৩ সাল থেকে দুবাই শাসন করে আসছে আল মাকতুম পারিবার। বর্তমান দুবাই এর আমির হলেন মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম। দুবাই বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ, দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও এমিরেটস গ্রুপ পরিচালনার দ্বায়িত্ব পালন করছেন আহমেদ বিন সাইদ আল মাকতুম। তিনি বর্তমান দুবাই এর আমীর মোহাম্মদ বিন রশিদের চাচা। এই মাকতুম পরিবারই দুবাই এর সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা