ভৌগোলিকভাবে দার্জিলিং জেলা দুটি অঞ্চলে বিভক্ত – পার্বত্য অঞ্চল ও সমতল। এই জেলার গোটা পার্বত্য অঞ্চলটি বর্তমানে গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসন নামে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনস্থ এক আধা-স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থার আওতাভুক্ত। এই এলাকা দার্জিলিং, কালিম্পং ও কার্শিয়াং মহকুমায় বিভক্ত। তবে গুরুত্বপূর্ণ শহর কালিম্পং মহকুমা কে ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পৃথক কালিম্পং জেলা ঘোষণা করা হয়। হিমালয় পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে সমভূমিতে শিলিগুড়ি মহকুমা অবস্থিত। এই সমভূমি তরাই অঞ্চল নামেও পরিচিত। দার্জিলিং শহরে হিমালয় পাহাড়ী অঞ্চলের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। ঋতুভেদে এর তাপমাত্র ১ থেকে ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। তবে এর বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দার্জিলিং এর সর্বনি¯œ তাপমাত্রা মাইনাস ২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড করা হেয়ছিল ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারি তে। দার্জিলিংয়ে সাধারণত তুষারপাত হয় না। তবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে সামান্য তুষারপাতের সম্ভাবনা থাকে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দার্জিলিংয়ে বিগত এক দশকের সর্বোচ্চ তুষারপাত দেখা যায়। দার্জিলিং শহরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। প্রতি বছর গড়ে ১২৬ দিন বৃষ্টিপাত হয় দার্জিলিংয়ে। সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকে জুলাই মাসে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবেই দার্জিলিং চা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত। ভারতের ১৬ টি রাজ্যে চা শিল্প বিকশিত হলেও, দার্জিলিং চায়ের সমকক্ষ চা কোথাও উৎপাদিত হয় না। শুধু ভারতই নয়, বরং সারা বিশ্বের চা শিল্পের তুলনায় দার্জিলিংয়ের চা কে সেরা বিবেচনা করা হয়। দার্জিলিং উপত্যকায় উৎপাদিত চীনা ক্যামেলিয়া প্রজাতির এই চা ভারতের অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়। বিশেষ সৌরভ ও গুণগত বিবেচনায় এই জাতের চায়ের নামই হয়ে গেছে দার্জিলিং চা। দার্জিলিংয়ের ২০ হাজার হেক্টর জমিতে গড়ে ওঠা ৮৩টি চা-বাগানে বছরে গড়ে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ কেজি দার্জিলিং-চা উৎপাদিত হয়।
১৭৮০ সালের পূর্বে দার্জিলিংয়ের এলাকা সিকিমের ছোগ্যালদের মালিকানাধীন ছিল। তারা বেশ কয়েকবার নেপালের গোর্খাদের আক্রমণ করে পরাজিত হয়। পরবর্তীতে নেপালী গোর্খারা সিকিম আক্রমন করে দার্জিলিং এবং শিলিগুড়ি অঞ্চল দখল করে নেয়। ১৯ শতকের শুরুর দিকে গোর্খারা তিস্তা নদী পর্যন্ত বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জয় করে। তখন পুরো উত্তর সীমান্তে গোর্খাদের দমন করতে ব্রিটিশরা উঠে পড়ে লাগে। ১৮১৪ সালের এংলো-গোর্খা যুদ্ধে গোর্খারা পরাজিত হলে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে ওঠে। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দার্জিলিং অঞ্চলে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর স্বাস্থ্য উদ্ধারকেন্দ্র নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ অঞ্চলের কিছু অংশ সিকিমিজদের কাছ থেকে লীজ নেয়। তারপর ১৮৫০ সালের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দার্জিলিংয়ের ১৭শ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে। ১৮৬৪ সালে ভ্টূান ও ব্রিটিশরা সিঞ্চুলা চুক্তি স্বাক্ষর করলে কালিম্পং সহ পাহাড়ের গিরিপথগুলো ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রনে আসে। ১৮৬৫ সালের মধ্যে তিস্তা নদীর পূর্ব তীর ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। ১৮৬৬ সালের মধ্যে ৩ হাজার ২০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে দার্জিলিং জেলা গঠিত হয়। ২০১৭ সালে কালিম্পং জেলা গঠিত হবার আগ পর্যন্ত দার্জিলিং জেলার এই আয়তন অপরিবর্তিত ছিল।
গ্রীষ্মকালে ভারতের প্রচ- দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা দার্জিলিংয়ের মনোরম আবহাওয়ায় বসবাস করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে দার্জিলিং একটি শৈলশহর ও স্বাস্থ্য উদ্ধারকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। আর্থার ক্যাম্পবেল ও রবার্ট নেপিয়ার এই পাহাড়ি শহর গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নেন। তাঁদের প্রচেষ্টার ফলে ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৯ সালের মধ্যে পাহাড়ের ঢালে চাষাবাদ ও ব্যবসা বাণিজ্য শুরু হলে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা শতগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সালের মধ্যে সমতলের সাথে সংযোগকারী প্রথম সড়কপথ নির্মিত হয়। ১৮৪৮ সালে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য অস্ত্রাগার নির্মিত হয় এবং ১৮৫০ সালে এই শহরকে পৌরসভায় উন্নীত করা হয়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাণিজ্যিক ভাবে চা চাষ শুরু হলে বেশ কিছু ব্রিটিশ চা প্রস্তুতকারক এখানে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং শহরকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষনা করা হয়। স্কটিশ ধর্মপ্রচারকরা ব্রিটিশ আধিবাসীদের জন্য এখানে একাধিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং হিমালয়ান রেল চালু হলে শহরের উন্নয়ন আরো দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ব্রিটিশ শাসনকালের শুরুতে দার্জিলিংকে অর্থনৈতিক ভাবে অনুন্নত জেলা হিসেবে গণ্য করা হত, যার ফলে ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য জেলাতে প্রযোজ্য আইন এই অঞ্চলে বলবৎ হত না। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলকে একটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দার্জিলিং অঞ্চলের চা বাগানগুলিতে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে সশস্ত্র বিপ্লবীরা বাংলার গভর্নর স্যার জন অ্যান্ডারসনকে দার্জিলিংয়ে হত্যার চেষ্টার করেন। পরবর্তীতে ১৯৪০-এর দশকে এই জেলার চা শ্রমিকদেরকে সংগঠিত করে কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং ও তরাই অঞ্চলের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত দার্জিলিং জেলাকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাথে যুক্ত করা হয়। পাহাড়ে নেপালীরা প্রধান জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করলেও তরাই সমতল অঞ্চলে বহু সংখ্যক বাঙালি বসবাস করতে শুরু করে। নেপালীদের দাবীর প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিস্পৃহ মনোভাবের কারণে দার্জিলিংয়ের স্বায়ত্তশাসন ও নেপালী ভাষার স্বীকৃতির জোড় দাবী ওঠে। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিক্কিম নামক একটি নতুন রাজ্যের উদ্ভব হলে, এই অঞ্চলে গোর্খাল্যান্ড নামক একটি নতুন রাজ্য তৈরীর জন্য ব্যাপক ও হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ নামক একটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদলের সৃষ্টি করা হয়, যাদের ওপর এই জেলার প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে আবার নতুন করে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে অন্দোলন করতে শুরু করে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাদেও সাথে আলোচনা করে গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসন নামে নতুন একটি আধাস্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নানা কারণে এ অঞ্চলের পাহাড়ি জনতা পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে অন্দোলন করে যাচ্ছে। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন সমস্পর্কে বিস্তারিত জানতে কি কেন কিভাবে র এই ভিডিওটি দেখুন। কি কেন কিভাবে চ্যানেলে আপনি নতুন হলে এই চ্যানেলের অন্যান্য ভিডিওগুলোও দেখতে থাকুন।
এ ধরনের ভিডিও নিয়মিত দেখতে চাইলে কি কেন কিভাবে সাবস্ক্রাইব করুন, আমাদের পরবর্তী ভিডিও আপলোড হওয়ার সাথে সাথে দেখতে চাইলে সাবস্ক্রাইব বাটনের পাশে বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।
এই ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক করুন, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আমাদের চ্যানেলে কি কি ধরনের ভিডিও দেখতে চান তা কমেন্টে লিখে জানান।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা