রণকৌশল, ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষমতার অভূতপূর্ব মিশেলে গড়া এক অভিনব চরিত্র চেঙ্গিস খান। এক সাধারণ গোত্রপতি থেকে তিনি হয়েছিলেন অতি নির্মম রক্তপিপাসু সাম্রাজ্যের মালিক। পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে তিনি হলেন সবচেয়ে সফল সেনাপতি। পূর্ব থেকে পশ্চিমের সভ্যতাকে এক করেছিলেন তিনি। তৎকালীন পৃথিবীর ১১ শতাংশ লোককে হত্যা করা হয় সরাসরি তার নেতৃত্বে।
কি কেন কিভাবে র এই পর্বে জানব পৃৃথিবীর সর্ব বৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খান সম্পর্কে।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী দাপুটে যোদ্ধা চেঙ্গিস খানের জন্ম মঙ্গোলিয়ার তৃণ চারণভূমিতে। ধারণা করা হয়, ১১৬২ সালে চেঙ্গিস খান উত্তর মঙ্গোলিয়ার খেনতি পর্বতমালার নিকটবর্তী দেলুন বলদাখ নামক স্থানে বোরজিগিন বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এক তাতার প্রধানের নামানুসারে বাল্যকালে তার নাম রাখা হয় “তেমুজিন”। চেঙ্গিস খানের পিতা ইয়েসুগেই মঙ্গোলিয়ানদের স্থানীয় দলনেতা হিসেবে বেশ কিছুসময় দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল ইউরেশিয়ান স্তেপ অঞ্চল, বিভিন্ন গোত্র, দল ও উপদলের মাঝে বিভক্ত ছিল। সেসবের মধ্যে তাতার, টার্কিক এবং মোঙ্গল গোত্র ছিল অন্যতম। চেঙ্গিস খানের জন্মের সময় স্তেপ ভূমিতে ছিল তাতারদের একক আধিপত্য। চেঙ্গিসদের গোত্রের সাথে তাতারদের ঘোর শত্রুতা ছিল। চেঙ্গিস খানের বয়স যখন মাত্র নয় বছর, তখন শত্রুরা তার পিতাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে। চেঙ্গিস খানের পিতার মৃত্যুর পর তার গোত্রের লোকজন অপ্রাপ্তবয়স্ক চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বকে অস্বীকার করে অন্যত্র চলে যেতে শুরু করে। এরপর দীর্ঘদিন তার মায়ের সাথে যাযাবর জীবন যাপন করেন তিনি। এই বিপদসঙ্কুল সময়েই মূলত চেঙ্গিস খান তার জীবনের সবেচেয়ে কঠিন শিক্ষাগুলো লাভ করে। প্রতিকূলতার মধ্যেই যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করার মাধ্যমে বিখ্যাত যোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে তেমুজিন। ১১৭৮ সালে ১৬ বছর বয়সে অঙ্গিরাত গোষ্ঠীর বোর্তে নামের এক নারীকে বিয়ে করেন তেমুজিন। ঘটনাক্রমে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী মোঙ্গল গোত্র অতর্কিত হামলা চালিয়ে তেমুজিনের লোকদের হত্যার পাশাপাশি তার স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
চেঙ্গিস খানের উত্থানের সাথে তার স্ত্রীর অপহরণের ঘটনার নাটকীয় যোগসূত্র রয়েছে। হামলার শিকার হবার পর তেমুজিন তার আপন ভাই জুমুখা কে নিয়ে তাদের পিতার বন্ধু তুঘরুল খানের শরণাপন্ন হয়। তখন তেমুজিন, জমুখা ও তুঘরুল খানের সহযোগিতায় তার স্ত্রী বোর্তেকে উদ্ধার করেন। বোর্তেকে উদ্ধারের ঘটনার মধ্য দিয়ে চেঙ্গিস খান, জমুখা ও তুঘরুলের মধ্যকার ঐক্য অত্যন্ত সুদৃঢ় হয়ে উঠে। এই সম্পর্কই পরবর্তীতে চেঙ্গিস খানকে শক্তিশালী হতে সাহায্য করেছিল। এই ঘটনার পরবর্তীতে খুব শীঘ্রই চেঙ্গিস খান মিত্র দল তৈরি করেন। এসময় তিনি যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলে, তার অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেনাবাহিনীর আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে উচ্চাভিলাষী চেঙ্গিস খান বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন। সেইসাথে তিনি অন্যান্য মোঙ্গল গোষ্ঠীদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেন। চেঙ্গিস খান একাধিপত্য সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শত্রু গোত্রীয় প্রধানদের হত্যা করার পাশাপাশি জীবিত সদস্যদেরকে নিজের গোষ্ঠীর সাথে একীভূত করেন। তৎকালীন মোঙ্গলদের রীতি অনুযায়ী অভিজাত বংশের লোকেরা সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হত। কিন্তু চেঙ্গিস খান সেনাবাহিনীর উচ্চপদের জন্য বংশ পরিচয়ের চেয়ে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। সেসময় পর্যন্ত চেঙ্গিস খানের গোত্রে সে ও তার ভাই একত্রে গোত্র প্রধানের দ্বায়িত্ব পালন করত। কিন্তু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে এবং তেমুজিনের মোঙ্গলরীতি বিরুদ্ধ কাজে তার ভাই জমুখার সাথে বিরোধ দেখা দেয়।
১২০৫ সালে মঙ্গোলিয়ান স্তেপ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকের নেতৃত্বে তেমুজিন ওরফে চেঙ্গিস খান ও অন্যদিকে তার ভাই জমুখা। তেমুজিনের দুর্দান্ত রণকৌশলে জমুখা বাহিনী পরাজিত হয়। পরবর্তীতে জমুখার লোকেরাই তাকে চেঙ্গিস খানের হাতে সোপর্দ করে। কিন্ত তেমুজিন তার ভাইকে হত্যা না করে পুনরায় একসাথে কাজ করার আওভান জানায়। কিন্তু জমুখা তার নিজের ইচ্ছাতেই মোঙ্গল রীতি অনুযায়ী মেরুদন্ড ভেঙে স্বেচ্ছা মৃত্যু বরণ করে। আর যেসব সৈনিক চেঙ্গিস খানের কাছে পুরস্কৃত হওয়ার আশায় জমুখার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের পরিণতি হয় খুবই ভয়ঙ্কর। চেঙ্গিস খান তাদের সবাইকে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করে হত্যার আদেশ দেয়। জমুখাকে পরাজিত করার পর মঙ্গোলিয়ার বাকি গোত্রগুলোও একে একে চেঙ্গিস খানের বশ্যতা মেনে নিতে থাকে। ১২০৫ সালের মধ্যেই তিনি তার সকল প্রতিদ্বন্দীদের হটিয়ে একক ভাবে সমগ্র মঙ্গোলিয়ার অধিপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এসময় তিনি সমগ্র রাজ্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সভা আহবান করেন। এই সভার মধ্য দিয়ে আধুনিক মঙ্গোলিয়ার আদলে নতুন এক রাষ্ট্র গঠন করা হয়। ১২০৫ সালের এই সভাতেই তেমুজিন-কে “চেঙ্গিস খান” উপাধি দেয়া হয়। যার অর্থ রাজাদের রাজা।
১২০৬-১২২৭ সাল পর্যন্ত এই ২১ বছর ছিল চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ। এসময় চেঙ্গিস খান মোঙ্গল সাম্রাজ্যের বিস্তারের লক্ষ্যে অভিযান শুরু করে। তার প্রথম অভিযান চীন থেকে তিনি যুদ্ধবিদ্যা ও কূটনীতির মৌলিক কিছু শিক্ষা লাভ করেন। ১২১১ সালে চীন অভিযানের প্রথমেই তিনি জিন রাজবংশকে পরাজিত করেন। এরপর ১২১৫ সালে চীনের জিয়া সাম্রাজ্য এবং ১২২০ সালে পারস্যের প্রবল প্রতাপশালী খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্য তার পদানত হয়। এদিকে আফগানিস্তান হয়ে ভারতের পাঞ্জাব পর্যন্ত মোঙ্গল বাহিনী চলে এসেছিল। এছাড়াও ককেশাস ও কৃষ্ণসাগরের আশেপাশের অঞ্চলগুলোও ধীরে ধীরে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এমনকি চিরকাল অজেয় রাশিয়া জয় করতেও মোঙ্গল বাহিনীর খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। তৎকালীন সময়ে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা যেসমস্ত অঞ্চল জয় করেছিল, তা থেকে আধুনিককালে প্রায় ২০ টিরও বেশি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। গণচীন, মঙ্গোলিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, আফগানিস্তান, জর্জিয়া, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, মলদোভা, দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং কুয়েতের মত অঞ্চলগুলো মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অধিকৃত হয়। এর মধ্যদিয়ে চেঙ্গিস খান পূর্ব এবং পশ্চিম সভ্যতাকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চেঙ্গিস খান আলেকজান্ডার দি গ্রেটের চেয়ে ৪ গুণ বেশি রাজ্য জয় করেন, এবং তার সা¤্রাজ্য রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিগুনেরও বড় ছিল।
চেঙ্গিস খান তার রণকৌশল, সাহস আর বুদ্ধিমত্তার জন্য ইতিহাসের পাতায় যেমন বিখ্যাত তেমনি তার রাজ্য জয় করার পদ্ধতির জন্য কুখ্যাত হিসেবেও পরিচিত। মোঙ্গল বাহিনী কোন শহর দখল করার পূর্বে সেই শহরের মানুষদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আদেশ করত। আর এই আদেশ অমান্য করলে সেখানে অবরোধ আরোপ করা হত। তারপর একসময় অনাহার ক্লিষ্ট নগরবাসীর উপর অতর্কিত হামলা চালানো হত। নারী, পুরুষ, শিশুসহ প্রায় সবাই এই মোঙ্গল বাহিনীর বর্বরতার শিকার হত। বেইজিং, সমরখন্দের মত জনবহুল শহরগুলো মোঙ্গল বাহিনীর পাশবিকতায় ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছিল। প্রায় ১২ লক্ষ মানুষের উরগেঞ্জ শহরটি জয় করতে ব্যাপক পাশবিকতার আশ্রয় নেয় মোঙ্গলীয়রা। এসময় চেঙ্গিস বাহিনীর ৫০ হাজার সৈনিকের প্রত্যককে গড়ে ২৪ জন করে নিরীহ মানুষ হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মোঙ্গল আক্রমণের ভয়াবহতার সাক্ষী হিসেবে মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু শহরের ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে আছে। ধারণা করা হয় চেঙ্গিস খানের বিভিন্ন অভিযানে প্রায় ৪ কোটির মত সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছিল যা তৎকালীন পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ। ১২২৫ সালে জাপান সাগর থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্য জয় করে মঙ্গোলিয়ায় ফেরত আসেন চেঙ্গিস খান। এর দুই বছরের মাথায় ১২২৭ সালে ঘোড়া থেকে পরে দেহের অভ্যন্তরে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয় চেঙ্গিস খান। পরবর্তীতে ১২২৭ সালের ১৮ই আগস্ট চেঙ্গিস খান মৃত্যুবরণ করেন। চেঙ্গিস খানের নৃশংসতা ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত হিসেবে পরিগণিত হলেও তার সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর রণকৌশল মোঙ্গলীয়দের আজও গর্বিত করে। সমগ্র মোঙ্গলিয়াকে একত্রিত করার জন্য তাকে মোঙ্গল জাতির পিতা বলা হয়ে থাকে।
চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল বাহিনী ভেদ করেছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে কঠোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চীনের মহাপ্রাচীর। এই সামরিক প্রতিরক্ষা স্থাপনা মোঙ্গলদের আগে আরও বহু আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম হয়েছিল।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা