ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ১ম ওসমানের পিতা এরতুগরুল গাজি ছিলেন তুর্কি বংশদ্ভুত কায়ী গোত্রের প্রধান। কায়ী গোত্র মধ্য এশিয়ায় চেঙ্গিস খানের আগ্রাসনের শিকার হয়ে আনাতোলিয়ায় চলে আসে। বর্তমান তুরস্কের ইউরোপ অংশ থ্রাস এবং এশিয়া অংশ আনাতোলিয়া নামে পরিচিত। কায়ী গোত্রপ্রধান এরতুগরুল রোম সালতানাতের সমর্থনে উত্তর পশ্চিম আনাতোলিয়া শাসন করেন। মোঙ্গল আক্রমনের ফলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে; এরতুগরুল বাইজেন্টাইন অঞ্চলে অভিযান চালায়। এক অভিযানে এরতুগরুল সোগুত জয় করে; সোগুতকে রাজধানী ঘোষণা করেন। ১২৫৮ সালে এই সোগুতেই ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ওসমান জন্মগ্রহন করেন। ১২৯৯ সালে এরতুগরুল গাজী মারা যাবার পর ১ম ওসমান বে নিযুক্ত হন। বে হলো বেগ বা প্রধান। বে বা বেগ শাসিত রাজ্যকে বেইলিক বলা হত। ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান প্রথম ওসমান উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়া বেইলিকের প্রধান ছিলেন। উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়া কেন্দ্রীক এই সালতানাতই পরবর্তিকালে বিশ্বের এক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
১২ শতকের দিকে মোঙ্গল আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে সেলজুক তথা রোম সালতানাত ভেঙে পড়তে থাকে। ১৪ শতকে এসে তা পুরোপুরি ভেঙে যায়। এরপর দৃশ্যপটে আসে ওসমানী সাম্রাজ্য। রোম সালতানাতের পতনের ফলে এই সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বেইলিকগুলো নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ১ম উসমান সাবেক রোম সালতানাতের বেইলিকগুলোকে জয় করার মাধ্যমে নিজের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ১ম উসমানের সময়ই তুরস্কের বেইলিকগুলোর অধিকাংশ করায়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে প্রথম ওরহান সুলতান হন। তিনি বাকি বেইলিক গুলো করায়ত্ব করে ইউরোপের দিকে অগ্রসর হন। প্রথম ওরহানের মৃত্যুর পর প্রথম মুরাদ ইউরোপের অনেক এলাকা জয় করেন। এই সময়েই ইউরোপের বলকান অঞ্চল ওসমানী সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়। ১৫ শতকে মোঙ্গল হালাকু খান বাগদাদ-কেন্দ্রীক আব্বাসীয় খেলাফত ধ্বংস করেন। পরবর্তিতে দ্বিতীয় মুহাম্মদ ওসমানীয় সাম্রাজ্য কেন্দ্রীক খেলাফত ঘোষণা করেন। যা ১৫৫৩ সাল থেকে ওসমানীয় খেলাফত হিসেবে পরিচিত হয়।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য সুলতানের শাসনামলঃ
সুলতান প্রথম ওসমান থেকে শুরু করে শেষ খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল মজিদ পর্যন্ত মোট ৩৭ জন ওসমানীয় সুলতান ও খলিফা এই সাম্রাজ্য ও খেলাফতের আসন অলংকৃত করেছেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন, সুলতান প্রথম ওসমান যিনি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া সুলতান প্রথম মুরাদ যিনি সাম্রাজ্যকে ইউরোপে বিস্তার করেন এবং ইউরোপের গুরুত্বপুর্ণ অঞ্চল বলকান জয় করেন। দ্বিতীয় মুহাম্মদের সময় রোমান খ্রীষ্টীয় বাইজেইন্টাইন সাম্রাজের পতন হয় এবং তুরস্ক কেন্দ্রীক ওসমানী খেলাফত কায়েম হয়। ১৫ শত বছরের পুরনো খ্রীষ্টীয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, যেই সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে খ্রীষ্ট ধর্ম বিকশিত হয়েছিল সেই সাম্রাজ্য সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের হাতে পতন হয় এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল মুসলিমদের অধীনে আসে। কন্সটান্টিনোপল বিজয় করে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ওসমানীয় খেলাফতের প্রথম খলিফা হন।
ওসমানীয় সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে দ্যি ম্যাগনিফিসেন্ট খ্যাত সুলতান প্রথম সুলাইমানের আমলে। সুলতান সুলাইমান ওসমানীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর সময়েই ওসমানী সাম্রাজ্য পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক থেকে ব্যাপক উন্নতি সাধন করে ওসমানী সাম্রাজ্য। এই সময়কালকে তুর্কি সালতানাতের স্বর্ণযুগ বলা হয়। ইউরোপের অনেক দেশ এসময় ইসলামি সাম্রাজ্যের অংশে পরিনত হয়। সুলতান প্রথম সুলাইমান ১৫২১ সালে বেলগ্রেড জয় করেন। উসমানীয়-হাঙ্গেরিয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাঙ্গেরি রাজ্যের দক্ষিণ ও মধ্য অংশ জয় করেন ১ম সুলাইমান। ১৫৪৭ সালে হাবসবার্গ শাসক ফার্ডিনেন্ড আনুষ্ঠানিকভাবে উসমানীয়দের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এছাড়া সমস্ত আরব ভূখন্ড ও আফ্রিকার বিশাল অংশ ওসমানী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ন্যায়বিচার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য সুলতান সুলাইমানকে কানুনি সুলাইমানও বলা হয়। তিনি শরিয়াহ আইন আক্ষরিক অর্থেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আইনের উর্ধ্বে কেউ ছিলনা; এমনকি সুলতান নিজেও কাজির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন।
নিকোপোলিশের যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত সর্বশেষ ক্রুসেড যুদ্ধ ওসমানীদের সময় সংগঠিত হয়। ১৩৯৪ সালে পোপ নবম বনিফেস ক্রুসেড যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে সুলতান বায়জিদ সম্মিলিত খ্রীষ্টান বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। যার ফলে ওসমানীয়দের জন্য পরবর্তীতে ইউরোপের অন্যান্য দেশ জয় করার পথ সুগম হয়। দ্বিতীয় মুহাম্মদ ওসমানীদের রাজধানী এড্রিনোপল থেকে কনস্টান্টিনোপল স্থানান্তর করেন যা বর্তমানে ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত। খালিফা দ্বিতীয় মুহাম্মদ থেকে ইস্তাম্বুল কেন্দ্রিক ইসলামি খেলাফত তুরস্কে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এই খেলাফত বহাল ছিল। আর এই খেলাফতের শেষ খলিফা ছিলেন দ্বিতীয় আব্দুল মজিদ।
সাম্রাজ্যের পতনঃ
ওসমানীয় সাম্রাজ্য প্রায় ছয়শত বছরের বেশী সময় ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে ইউরোপীয়দের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সেক্যুলারিজমের বিস্তার এ সাম্রাজ্যের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এছাড়া ইহুদী-খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্র, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কিংবা আরব বিদ্রোহ সাম্রাজ্যটির সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে ভূমিকা রাখে। ১৯০৮ সালে তরুণ তুর্কি বিপ্লবের পর দ্বিতীয় সাংবিধানিক যুগ শুরু হয়। বিপ্লবের পর ১৮৭৬ সালের সংবিধান এবং উসমানীয় সংসদ পুনরায় চালু করা হয়। বিপ্লব পরবর্তী ছয় বছর ব্যাপক আকারে রাজনৈতিক ও সামরিক সংস্কার করা হয়। আর এই সময়কালকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সূচনা হিসেবে মনে করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি জোট পরাজিত হলে তুর্কি সালতানাত ভেঙ্গে পড়ে। পরবর্তীতে পশ্চিমা মদদপুষ্ট কামাল পাশা তুরস্কের রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করে। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর কামাল পাশা তুর্কি সালতানাত বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুর্কি গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি তুরস্ককে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। সালতানাত বিলুপ্ত করা হলেও তখনো খেলাফত বহাল ছিল। শেষ তুর্কি সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ দেশ ছেড়ে চলে গেলে তাঁর ভাই দ্বিতীয় আব্দুল মজিদকে নামে মাত্র খলিফা করা হয় কিন্তু তাকে কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ কামাল পাশা প্রায় ৬ শত বছরের এই শাসন ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। শেষ খালিফা দ্বিতীয় আব্দুল মজিদকে ফ্রান্সে নির্বাসিত করা হয়। সাবেক ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলো বর্তমানে ৪৯ টি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে। ৫২ লাখ বর্গকিমির ওসমানী সাম্রাজ্য এখন তিন লাখ বর্গমাইলের তুরস্কে পরিণত হয়েছে।
উসমানীয় স¤্রাজ্য পতনের পেছনে নানাবিধ কারণ থাকলেও, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ এই প্রক্রিয়া কে ত্বরান্বিত করে। প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের পতন, একাধিক নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় কিংবা ৭ কোটি সেনার অংশগ্রহণের মত আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার সম্মিলন ঘটেছিল ১ম বিশ্বযুদ্ধে। এ বিশ্বযুদ্ধের মত ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ববাসী অতীতে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। মানব ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক এক অধ্যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে কি কেন কিভাবে র এই ভিডিওটি দেখুন। কি কেন কিভাবে চ্যানেলে আপনি নতুন হলে এই চ্যানেলের অন্যান্য ভিডিওগুলোও দেখতে থাকুন।
এ ধরনের ভিডিও নিয়মিত দেখতে চাইলে কি কেন কিভাবে সাবস্ক্রাইব করুন, আমাদের পরবর্তী ভিডিও আপলোড হওয়ার সাথে সাথে দেখতে চাইলে সাবস্ক্রাইব বাটনের পাশে বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।
এই ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক করুন, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আমাদের চ্যানেলে কি কি ধরনের ভিডিও দেখতে চান তা কমেন্টে লিখে জানান।
ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা